পাতা খেলা কি এবং পাতা খেলার মন্ত্র শিখুন

পাতা খেলা

__ মোঃ সবুজ হোসেন

আষাঢ়-শ্রাবণ মাস এলেই আমার মনে পড়ে শৈশব-কৈশোরে দেখা পাতা চালা খেলার কথা। আর  সেই সঙ্গে মানসপটে ভেসে ওঠে পাতা খেলার চালার গুণীক আমার দাদা ।  আমার দাদা ছোট থেকে তার উস্তাদ লোফরা প্রমানিক এবং মজির এর কাছে থেকে তন্ত্র মন্ত্র শিখেছিল ।

আমার প্রথম জীবনে আমার দাদা মোঃ অকিম উদ্দিন  কবিরাজ ছিলেন পাতাচালা খেলার ওস্তাদ  তাঁর সঙ্গীয় গুণীক ছিল মজির দাদা

         ছোট বেলা দেখেছিআষাঢ়-শ্রাবণ মাসে চারদিকে পাতা চালা খেলার ধুম। ঢাকের আওয়াজ। তুলারাশি পাতার কদর আর দাদা দলের বাহাদুরী। অন্য গুণীকদল তাঁদের কাছে ছার।  দাদার চাকল কেঁটে কোন গুণীকই পাতা আনতে পারতো না।

পাতাকে চাকল দিতে তিনি যে সমস্ত মন্ত্র পাঠ করতেন তার মধ্যে একটি আওয়াজ আমার মনে পড়ে-



 

‘‘দমদম মাদারদমদম মাদারহুয়াল কোরআনবাহিরে ভিতরে বন্ধোঁবন্ধোঁ সোবহানব্রহ্মাবৃষ্ণমহেশ্বরচোখেমুখে বন্ধোকররামের হাতের ধনুর্বানকিয়ামতের থলিবাঘ ভাল্লুকের জবান বন্দোঁহাঙ্গড়ের বন্ধোঁ বুলিরক্ষা কর রাজা বন্ধোঁ / প্রজা বন্ধোঁ / ডাকিনী বন্ধোঁ পিছে/১৮ হাজার আলম বন্ধোমা ফাতেমার জটে/

পাতাকে সিংগার দেওয়া মন্ত্রের মধ্যে একটি-

‘‘ শির শির তলোয়ারে বিষমারণু চুট্কি উড়ানু বিষধা বিষ ধাআছমান-জমিনে ধাপাতার মণি মগজে ধা/সর্ব-শরীরেরগে রগে রগে ধাছু-----

         তাঁর ডাক মন্ত্রের মধ্যে একটি মন্ত্রের নাম বার মাসী। সকলের জ্ঞাতার্থে বারমাসী মন্ত্র দিয়ে ইতি টানছি-

পাতা খেলার মন্ত্র 

‘‘ আগন মাসে সু সংহতি।

শোনহে বিষের মহারাজ পতি \

পৌষ মাসে ধবল পড়ে।

তখন বিষ ঘোটকের পরে \

মাঘ মাসে তাতাল পাতাল।

বিষ তখন ভঁওরে পাতাল \

ফাল্গুণ মাসে গরল জাড়।

বিষের চোটে কাঁপে হাড় \

চৈত্র মাসে লাংগল ছেও।

আইলে বিষ পাড়ে ডেও \

শাওণ মাসে সিংহ রাণী।

শোনহে বিষের কাহিনী \

ভাদ্র মাসে আউশ ধান।

বিষে করে হান্ পান \

আশ্বিন মাসে কাইশা ফোলে।

বিষ তখন ঘাটা পথে চলে \

কার্তিক মাস বছরের শেষ।

পাতার হাতে বিষ করিল প্রবেশ \

উজান ছেড়ে বিষ যদি হেটে যাস।

দোহাই লাগে ৩০ কোটি দেবতা-

পদ্মাার মাথা খাস্ \

আঁচলি করার মন্ত্র-/

উবুচুবু দীঘি কোনাবাঘের চক্কর গায়,

এই আচঁলি করিয়াছেচাঁন-সুরুজের মায়।

মোর আচলি ছেড়ে যদিঅন্য আঁচলিত যাস।

দোহাই লাগে ৩০ কোটি দেবতাপদ্মার মাথা খাস্


দেশীয় খেলা পাতাচালা-

মোঃ সবুজ হোসেন

১৭/০৪/০৯ইং

 

ছোট বেলা পাতা চালা খেলা দেখেছি। পাতা চালা 

একটি দেশিয় খেলা। পাতা বলতে তান্ত্রিক মতে বিশেষ রাশির মানুষের হাতে জাক মন্ত্র বলে বিষ তুলে দিয়ে তাকে সম্মোহিত করাকে বোঝায়।  কেকবে কোথায়  পাতাচালা খেলার সূচনা করে তা সঠিক জানা যায় না। তবে জনশ্রুতি হিসেবে বলা যায় যে

প্রাচীন কালে কামরুপ কামাখ্যার তান্ত্রিকেরা বিষাক্ত সাপ দিয়ে তাদের তন্ত্র মন্ত্রের পরীক্ষা  বাহাদুরী দেখাতো। তুড়মি বাঁশি বা বীন বাজিয়ে সাপকে সম্মোহিত করে আনা কিংবা সাপে কাটা সাত দিনের মৃত মানুষকে পুনঃর্জীবিত করার কিংবদন্তী  আজো আমাদের দেশে প্রচলিত আছে। সম্ভবতঃ তন্ত্র মন্ত্রের এসব অন্ধ বিশ্বাস থেকেই পরর্বতীতে পাতাচালা খেলার

উৎপত্তি।

 

রাশিগত ভাবে পাতা  ধরণের হয়ে থাকে।

 (গুরু সত্য পাতা

(মাশানের পাতা 

(মিশালের

পাতা  বা তুলারাশি পাতা। পাতাচালার

 

খেলার জন্য   ধরণের পাতাই প্রযোজ্য। তবে তুলারাশি পাতা সর্বোৎকৃষ্ট। পাতাচালা খেলার গুনীক বলতে তন্ত্র মন্ত্র সাপের ওঝাদেরাকেই  বুঝায়। একাজে আদিবাসীসাঁওতালমাল-পাহাড়ীরই ওস্তাদ। পূর্বে হিন্দুমুসলমান  আদি বাসীদের মধ্যে পাতা চালা খেলার অনেক গুনীক দৃষ্ট হতো।

পাতা চালা  সাপের মন্ত্রগুলি হিন্দুদের বিভিন্ন দেবদেবীর জীবন কাহিনী নিয়ে রচিত। সে গুলোর পাশাপাশি মুসলমান পীর ফকিরের কাহিনী  দোয়া কালমার সাথে সংমিশ্রন দেখা যায়। কতগুলি মন্ত্র সাঁওতালীসংস্কৃতি  আরবী ভাষার মিশ্রণে প্রণীত। পয়ার বা ত্রিপদী ছন্দে রচিত  শ্লোকগুলির রচয়িতা কে বা কারা তা বলা দুষ্কর। অন্যান্য খেলার মত পাতা চালা খেলারও কিছু নিয়ম কানুন থাকে। থাকে একটি সুদক্ষ আয়োজক কমিটি। কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক খেলারো স্থানতারিখ  সময় নির্ধারণ করা হয়। হাটে ঢোল সহরত করে চলে প্রচারণার কাজ। বিভিন্ন এলাকার তান্ত্রিক দল বা গুনীক দলের সাথে সংযোগপাতা নির্বাচনঢাক ঢোল কন্ট্রাকপ্রতিযোগীতার পুরষ্কার সংগ্রহসর্বোপরি সুষ্ঠুভাবে খেলা পরিচালনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েই কাজে অগ্রসর হয় আয়োজক কমিটি।

 

খেলার নির্ধারিত দিনে মাঠের মাঝখানে পুঁতে দেয়া হয় একটি অফলা কলার গাছ। তাকে আবার সাদা কাপড় দিয়ে সাজানো হয়। দেবী পদ্মার প্রতি কৃত। তার নিচে একটি পিতলের ঘটিতে রাখা হয় পানি। সকাল থেকেই বায়েনরা ঢাক ঢোল পেটাতে থাকে। দুপুর হতে হতেই লোকে লোকারণ্য হয় খেলার মাঠ। সাধারণতঃ বিকেল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে এই খেলা। বিকেলে খেলার মাঠের চারদিকে লোকজন ঘিরে বসে। নিজ নিজ আসন পেতে বসে গুনীকের দল। তাদের কারো হাতে বিভিন্ন ঔষধি গাছের শিকড়। কারো হাতে কলার লেঙ্গুজ পাতা,কবুতর  ছুরি। কারো মাথায় পাগড়ী। কারো কাঁধে গামছা ঝুলানো। কারো কোমরে বাধা থাকে গামছা। আদিবাসী সাঁওতালদের কারো কারো বিষাক্ত সাপো থাকতো সেকালে। যা হোক এগুলো হলো খেলার পূর্ব প্রস্তুতি। সকল প্রস্তুতি শেষে কমিটির লোকজন এক বা একাধিক পাতা নিয়ে খেলার মাঠে প্রবেশ করে। মাঠের মধ্যে যেখানে কলাগাছ পোঁতা আছেসেখানে নিয়ে যাওয়া হয় পাতাকে।

 তারপর গুনীকদের মধ্যে থেকে তাদের সম্মতি ক্রমে নিরপেক্ষ কোন গুনীককে পাতার কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। গুনীক সাহেব ঘটির পানিতে মন্ত্র পাঠ করে পাতার হাতে ছিটিয়ে দেয়  মন্ত্র পাঠ করতে থাকে। কিছুক্ষণ মন্ত্র পাঠ করতে করতে পাতার হাত থর থর করে কাঁপতে থাকে। পাতার হাত উঠলে গুনীকসহ সকল লোকজন পাতার নিকট হতে চলে আসে। খেলার মাঠের মধ্যে থাকে শুধু পাতাই। এবারে চার পার্শ্বের আসন নিয়ে বসা গুনীকেরা পাতা ডাকতে শুরু করে। পাতা ডাকার বহু জনের বহু ধরনের মন্ত্র জানা থাকে। এখানে একটি মন্ত্র উদ্বৃত হলোঃ-

কলার গাছে বিষ দেওয়ার মন্ত্রঃ

সূরা ঝিলঝালাহ ৩, ৫,৭ বার পডিয়া এক বাটি পানিতে ফু দিবে। এবং ঐ পানি কলার গাছে ছিটাইবে তারপর কিছু পানি ঢোলে ছিটাইবে । এবং ঢোল বাজানো আরম্ভ করবে ঢোলের আওয়াজ তুলা রাশি শুনতে পাইলে ছুটিয়া সেই খানে চলে আসবে এবং মাটিতে মাথা আঁচড়াইবে ও হাত ঝাড়তে থাকিবে।।

 

 

পাতাচালা খেলার ডাক মন্ত্রঃ

আগন মাসে সু সংহতি। শোনহে বিষের মহারাজ পতি। পৌষ মাসে ধবল পড়ে। বিষ তখন ঘোটকের পাড়ে। মাঘ মাসে  তাতাল-বাতাল। বিষ তখন সাঁতরে পাতাল। ফাগুন মাসে গরল ঝাড়। বিষের চোটে কাঁপে হাড়। চৈত মাসে বসন্ত বাঁও। আঁলে বিষ পাড়ে ড্যাও। বৈশাখ মাসে লাঙ্গল ছ্যাও। বিষে করে ৪২ আও। জ্যৈষ্ঠ মাসে নরবলি। বিষ করে গড়াগড়ি। আষাঢ়ে আমাত তিথি। বিষের ডিম ফোটে ওঁতি। শাওন মাসে সিংহরানী। শোনহে বিষের কাহিনী। ভাদ্র মাসে আউশ ধান। বিষ করে হান্-পান্। আশ্বিন মাসে কাইশা ফোলে। বিষ তখন ঘাটা পথে চলে। কার্তিক মাস বছরের শেষ। পাতার হাতে বিষ করিল প্রবেশ। ওঠ বিষ নড়েউঠ্ বিষ চড়ে। সিঙ্গার দিনু বিষ পদমনির জোরে। উজান ছেড়ে বিষ যদি হেটে যাস। দোহাই লাগে পদ্মার মাথা খাস। ছু-মন্ত্র-ছু। (চলবে)



 খেলা পাতাচালা-

২০/০৪/০৯ইং  

এরুপ বিভিন্ন গুনীক দল তাদের জানা মন্ত্রগুলি সশব্দে পাঠ করতে থাকে। দর্শক মন্ডলী তন্ময় হয়ে শোনে গুনীকদের এসব মন্ত্রপাঠ। আর দৃষ্টি নিবন্ধ রাখে পাতা কার আসনের দিকে চলে যায়। যার মন্ত্রের জোর বেশী হয়পাতা তার আসনে চলে আসে। তখন মানুষ আনন্দে হাত তালি দিতে থাকে। পাতা যার আসনে চলে আসেসে বা সে দলের গুনীকরা পাতার হাতের বিষ নামায়। যাকে বলে পাতার হাত নামানো। হাত নামানোর মন্ত্রঃ 

পাতা খেলার মন্ত্র কি

আদি মাতা বসুমতি। তুমি মোর মাও। তুমি মাও থাকতে। কেন মোকে চড়ালো মাও। যা বিষ যা। কালি দহ সাগরে যা। এক তালদুই তালতিন পাতালে যা। নাম বিষ নাম। সপ্তমুল পাতালে নাম। হেট ছেড়ে বিষযদি উজান যাস। দোহাই লাগেপদ্মার মাথা খাস। ছু-মন্ত্র-ছু।

বিষ নামানোর পর পাতার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে। নাস্তা পানি খায়। ধুমপান করে। তখন গুনীকেরা পাতাকে চাকল দেয়। চাকলের মন্ত্রঃ 

আলিফ বে,তে,ছে। তিন হরফে মোরচাকল বন্ধ করে দে। মোর  চাকলের উপরযে চড়াবে ঘাও। মুহাম্মদী কলমা পড়ে তার হলকুমে দিনু পাঁও। ছু-ছু মন্ত্র ছু।

পাতার চার পার্শ্বে ঘুরে ঘুরে এই মন্ত্র পাঠ করে চাকল দিয়ে পাতাকে বন্দী রাখা হয়। চাকলের মধ্যে আবার ঔষধি গাছের শিকড়ের উপর মন্ত্র পাঠ করে আঁচলি করা হয়। সত্যিকারের পাতা হলে এই গোপন আঁচলি না তুলে অন্যত্র যেতে পারে না। আঁচলি করার মন্ত্রঃ উবু চুবু দীঘি কোনা। বাঘের চক্কর গায়। এই আচলি করিয়াছে। চান সূরুজের মায়। মোর আঁচলি ছেড়ে যদি অন্য আঁচলিতে যাস। দোহাই লাগে মা ফাতেমার মাথা খাস। ছু-মন্ত্র-ছু। এই আঁচলি  চাকল কেটে অন্য দলের গুনীক পাতাকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। তারা সমবেত ভাবে আবার ডাক মন্ত্রচাকল কাটা  আঁচলি কাটার মন্ত্র পাঠ করতে থাকে। চাকল কাটার মন্ত্রঃ বিসমিল্লাহ হায়তাল। নুরনবী নূরুশান। পাতার কলিজা হান। প্রথমে সাজিল বান নামে হরিহর। যাহার গর্জনে খাকি করে পর পর। খুর হেনবান সাজে খুরের আকার। খুব ধারে কাটে কত পর্বত-পাহাড়। পাহাড় পর্বত কেটেনা পুরিল আশ। চাকল আঁচলি কেটে করিল বিনাশ। ছু-মন্ত্র-ছু।

 

এভাবে চাকল  আঁচলি কেটে অন্য দল পাতা নিজ আসনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। যে দল যত বেশিবার পাতা নিয়ে যেতে পারে অথবা কোনো দলের চাকল অন্য কোনো দল কাঁটতে অপরাগ হয় সে দলকে বিজয়ী দল ঘোষণা করা হয়।  খেলায় গুনীকে গুণীকে বান মারা মারিও ঘটে। তাতে পাতা বা গুনীকের কোনো কোনো ক্ষেত্রে জীবনাপন্ন হয়। পাতা বা কমিটির নিরপেক্ষতার প্রশ্নের ব্যাপারে দাঙ্গা হাঙ্গামাও হয়ে থাকে। বর্তমান বিজ্ঞান সচেতন প্রজন্মের কাছে পাতা চালা খেলা উপেক্ষিত হলেও যুগ আগে  খেলা দেশের গ্রামীন মানুষের আনন্দসম্প্রীতি  প্রতিযোগীতার সার্বজনীন উৎসব ছিল  কথা সর্বজন বিদিত।


বিঃদ্রঃ পাতা খেলা শিক্ষার কিছু ডাইরি আমার কাছে আছে নিতে চাইলে যোগাযোগ করুন PDF ফাইল বিক্রি করা হবে ।


imo & whatsapp no: 01828370914

 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন

এখানে ক্লিক করে বই ডাউনলোড করুন