তন্ত্র মানে কি

তন্ত্র পরিচয়

সকলেই হয়তো প্রশ্ন করতে পারেন—তন্ত্র কি? 

এ সম্পর্কে সংস্কৃতে বলা হয়েছে— ‘তন্ত্র'। 'তন’ শব্দটির অর্থ হলো—তনু, অর্থাৎ দেহ বা শরীর। আর 'ত্র' শব্দটি হলো—– ত্রাণ বা রক্ষা। এই হলো ‘তন্ত্র' অর্থাৎ তন্ + ত্র = তন্ত্র। কথাটির বাংলা অর্থ হলো—যার সাহায্যে তনুকে ত্রাণ করা যায়, অর্থাৎ দেহ (শরীর)-কে রক্ষা করা যায়, তার নামই তন্ত্র। তন্ত্রের অন্যান্য দিকগুলি হলো— জনকল্যাণ, আয়ুর্বেদশাস্ত্র, মন্ত্রানুষ্ঠান, জীবনবিজ্ঞান, জ্ঞান-বিজ্ঞান প্রভৃতির দিশারী।

অনেকের মুখেই শোনা যায়—বেদের বহুপূর্বে তন্ত্রশাস্ত্রের উদ্ভব হয়েছে। বেদ রচনাকালীন তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ প্রচলিত ছিল না। বহু প্রাচীনকাল থেকেই এই তন্ত্র-মন্ত্র ও তার প্রভাব শুধু ভারতেই নয়, পাশ্চাত্য দেশগুলিতেও আদৃত হয়েছিল।

জ্ঞান-বিজ্ঞানে ভারত

ইতিহাসের জন্মের বহুকাল আগে থেকেই ভারত নানারকম গবেষণা, অনুসন্ধান ও আবিষ্কারে অগ্রণী ছিল। ভারতীয় যোগের শক্তি যে কতখানি, সে কথা আজ আর কারও অবিদিত নয়। ভারতীয় যোগের প্রভাব প্রত্যক্ষ করে সারাবিশ্ব আজ বিস্মিত। তারই ফলস্বরূপ আজ সারা বিশ্বে যোগাসন ও যোগ-ব্যায়ামের শিক্ষা গ্রহণের জন্য শিক্ষালয় খোলা হয়েছে। যেখানে শত শত শিক্ষার্থী ও শিক্ষার্থিনী যোগাসন ও যোগব্যায়াম শিক্ষা করছেন।

আর্য ঋষিগণ ছিলেন সূক্ষ্মদর্শী, তাঁদের চিন্তাধারা ছিল খুবই প্রখর। তার ফলে বিজ্ঞানীগণও মাথা নত করেছিলেন। অরণ্যচারী ঋষিগণ বনে ফলমূল খেয়ে দীর্ঘায়ু হয়ে বেঁচে থাকতেন কিভাবে?—সে কথা চিন্তা করে আজ সারাবিশ্ব বিস্মিত। বর্তমানে আমরা নানারকম উপাদেয় খাদ্য, খাদ্যপ্রাণ খেয়েও স্বল্পায়ু–এটা সকলেরই চিন্তা করে দেখার বিষয়। প্রচণ্ড শীতে যখন আমরা লেপ-কম্বল গায়ে দিয়ে কাঁপতে থাকি, তখন একজন যোগী নগ্নদেহে হিমালয়ের বরফে অবিচলিতভাবে বসে আছেন। ক্ষুধা-তৃষ্ণা, শীত-গ্রীষ্মকে তাঁরা যোগের মাধ্যমে জয় করেছেন।

মন্ত্র ও তার প্রভাব

মন্ত্র হলো শব্দ বা শব্দের সমষ্টি। কিছু কিছু বিশেষ অক্ষর ও শব্দের সমষ্টিগত গুণ আছে যে, যাকে বার বার বিশুদ্ধভাবে উচ্চারণ করলে তার সংঘর্ষণে আবহাওয়ায় একটা বিশেষ প্রকার বিদ্যুৎ তরঙ্গ উৎপন্ন হয়ে মানসিক চিন্তাকে অভীষ্ট উদ্দেশ্যে পুষ্ট করতে থাকে। এই শব্দই হলো মন্ত্র। এই মন্ত্র সাধকের ইচ্ছাপূরণ করে। এই মন্ত্রের সঙ্গে। ইচ্ছাশক্তির প্রয়োজন; আবার মন্ত্রের সাহায্যে ইচ্ছাশক্তিও প্রবল হয়। কাজেই উভয়ে উভয়েরই পরিপূরক। সেজন্য মন্ত্রসাধনা করতে হয়।

মন্ত্র হলো ভারতের সূক্ষ্মদর্শী মুনি-ঋষিগণের একটা অসীম প্রভাবশালী উপলব্ধি। তাঁরা মনন-বৃত্তির উপর নির্ভর করেই মন্ত্র রচনা করেছিলেন। মনন দ্বারা পেয়েছিলেন বা উপলব্ধি করেছিলেন বলেই মন্ত্র নাম হয়েছে। সাহিত্যের অন্তর্গত শব্দ হলো মন্ত্র। মূল অক্ষর এবং বীজ, তার ধ্বনি বা শব্দের প্রভাব এবং তারও তারতম্যের আনুষঙ্গিক সমস্ত কিছু বিশ্লেষণ করেই মন্ত্র বিদ্যার বিকাশ। কাজেই মন্ত্র যে শক্তিহীন নয়, তা সহজেই বুঝতে পারা যায়।

মন্ত্র এবং তার উপজীব্য হলো—যন্ত্র-তন্ত্র। এরই মাধ্যমে প্রাচীন ঋষিগণ মোক্ষ ও মহাসমাধি লাভ করতেন। অপরদিকে এই ভৌতিক জগতে এর প্রয়োগের সাহায্যে অভীষ্ট সিদ্ধিগুলিও লাভ করতেন। সাধকগণ সবার সাধনের জন্য এইসব প্রয়োগ করতেন, আবার কেউ নিজের স্বার্থেও প্রয়োগ করতেন। তবে একটা কথা বলা যায়—তাঁরা সাধনায় সিদ্ধিলাভ করে তা জনকল্যাণেই প্রয়োগ করতেন, স্বার্থপরের ন্যায় নিজের অভীষ্টসিদ্ধির জন্য নয়। এই গ্রন্থে তার অসংখ্য উদাহরণ দেওয়া হয়েছে।

যন্ত্র কি...?

পরবর্তীকালে ‘মন্ত্র’ তিনটি রূপে প্রকাশ পায়। প্রথম হলো—মন্ত্র। দ্বিতীয়— যন্ত্র। এবং তৃতীয়—তন্ত্র। মন্ত্রের বিষয় এর পূর্বেই আলোচনা করা হয়েছে। এবার যন্ত্রের সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে কিছু আলোচনা করা হচ্ছে।

এই যন্ত্র পদ্ধতিটি কোনও ভৌতিক পদার্থবাদীর সঙ্গেও সম্বন্ধ রাখে। যন্ত্রসাধনার ক্ষেত্রে সাধককে জপ করতে হয়। যন্ত্রসাধনার ক্ষেত্রে সাধক মন্ত্র জপের সঙ্গে নানারকম চিত্রের মাধ্যম ব্যবহার করে থাকেন। এইসব চিত্রের রেখা, অঙ্ক, বিন্দু ও সেইসঙ্গে শব্দ সংযোজন করে ধাতু নির্মিত পাত্র, ভূর্জপত্র কিংবা অপর কোনও বস্তুর উপরে যন্ত্র অঙ্কন করতে হয়। এতে তিনটি প্রভাব একসঙ্গে সক্রিয় হয়ে অসীম শক্তিশালী হয়ে ওঠে। যেমন— মন্ত্র জপের দ্বারা উদ্ভূত ধ্বনি বা শব্দের প্রভাব (Sound); যন্ত্রে লিখিত অঙ্ক ও রেখার প্রভাব বা দর্শন প্রভাব; ধাতব বা অন্য কোনও বস্তুর ভৌতিক প্রভাব। যথাযথ নিয়মে তৈরী যন্ত্র কোন স্থানে রাখলে, ধারণ করলে বা নির্দিষ্ট স্থানে ঝুলিয়ে রাখলে মন্ত্র ও যন্ত্র প্রচণ্ড প্রভাব বিস্তার করে। এটি অত্যন্ত ফলপ্রদ।

তন্ত্র সাধকগণ মহাদেবকে নিজেদের আদিদেব বলে স্বীকার করেন। এর কারণ তন্ত্রশাস্ত্র হলো স্বয়ং মহাদেবের শ্রীমুখনিঃসৃত বাণী, যে কথা আগেই বলা হয়েছে। বিভিন্নভাবে এই তন্ত্রকে সকল সম্প্রদায়ই মান্য করে চলেন।

ঐতিহাসিক দিক থেকে দেখলে দেখা যায়—খ্ৰীষ্টাব্দ শুরু হবার প্রায় দু' হাজার বছর আগে তন্ত্র-গ্ৰন্থসমূহের রচনা শুরু হয়েছিল। দেড় হাজার বছর আগে তন্ত্র শুধু ভারতবর্ষেই নয়, ভারতবর্ষের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। বৌদ্ধযুগে তন্ত্রের প্রভাব অত্যস্ত বেশী ছড়িয়ে পড়েছিল। বর্তমানে অনেক দুর্লভ তন্ত্র-মন্ত্র বা পাণ্ডুলিপি বৈদেশিক আক্রমণে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। বিদেশীরা ভারতবর্ষের সংস্কৃতি ও শ্রীকে নষ্ট করার জন্যই—শুধু তন্ত্রশাস্ত্রই নয়, আরও বহু অমূল্য গ্রন্থ অগ্নিদগ্ধ করে নষ্ট করে দেয়।

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন

এখানে ক্লিক করে বই ডাউনলোড করুন