রাজশাহির বিখ্যাত তন্ত্র মন্ত্র সংগ্রহ । মন্ত্র কি...? কত প্রকার দেখে নিন...? মন্ত্র কাকে বলে...?



জীবনের পরিণতি মরণে। জীব-জগতের এ বিধি দুর্লঙ্ঘ্য, শাশ্বত। জরা-মৃত্যু, শোক-দুঃখ থেকে পরিত্রাণের প্রয়াসেই ঈশ্বর-চিন্তা, ধর্ম-ভাবনা। গৃহী সাধক, সংসার বিরাগী সন্ন্যাসী, সকলেরই সাধনার মূল লক্ষ্য অনন্ত-অসীম জীবন কামনা, অমরত্ব লাভ। কায়-মনের সজীবতা, সুস্থতা, অমরত্বের বাসনা থেকে উদ্ভুত যোগ-ব্যায়াম নির্ভর কায়িক সাধনা তথা তান্ত্রিক সাধনা। অজেয় অজ্ঞেয় মরণ জয়ের, রোগ নিরাময়ের দুশ্চর প্রার্থনার ফসল ঝাড়-ফুঁক, তুক-তাক, তাবিজ-কবজ, মন্ত্র-তন্ত্র ও দারু-টোনা।

মানুষ স্রষ্টার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, প্রকৃতির সেরা সন্তান। লালনে-পালনে, সেবায়-রক্ষায়, ত্রাণে-পরিত্রাণে গর্ভধারিণী জননী আর অন্নদায়িনী প্রকৃতি প্রকৃত অর্থেই এক ও অভিন্ন। সভ্যতার ক্রমবিকাশের স্তরে স্তরে অগ্নি-বায়ু-জল, লতা-গুল্ম-ফুল-ফল, ধূলি-বালি কণার অবদান নানা মাত্রিক। দৈহিক সৌন্দর্যে, রোগ নিরাময়ে, প্রয়োগে প্রলেপে এদের ভূমিকাই মুখ্য। মানব জীবনের শ্রেষ্ঠ লীলাক্ষেত্র, সেরা শিক্ষা নিকেতন প্রকৃতি। যা কিছু জানার শেখার তার সবটাই মানুষ অর্জন করেছে প্রকৃতির বিশাল ভাণ্ডার ও চিরন্তন প্রবাহ থেকে। স্থানিক-কালিক-দৈশিক ভেদে তার রূপায়ণ ঘটেছে স্বল্পতায়-দীর্ঘতায়, খণ্ডিতে-পূর্ণতায়। মানব মনীষার এই বিচিত্র মুখী কর্ম-দর্শন, সাধন-পর্যবেক্ষণের মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠেছে দৈহিক-মানসিক সুস্থতার প্রক্রিয়া-প্রকরণ। স্বীকৃতি পেয়েছে রোগ নিয়ামক ও নিরামেয় নানাবিধ উপাদান-উপকরণ।

লোকচিকিৎসা ও লোকসমাজ সুপ্রাচীন কাল থেকে এদেশে চিকিৎসার দু'টো পদ্ধতি চলে আসছে। একটি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালব্ধ পদ্ধতি; অপরটি লোকপরম্পরায় চলে আসা পদ্ধতি; যা দেখে দেখে শেখা, শুনে শুনে জানা। লোকবিদ্যার এই শেষোক্ত ধারাই লোক থেকে লোকান্তরে, কাল থেকে কালান্তরে, দেশ থেকে দেশান্তরে প্রচারিত প্রবাহিত । লোকবিজ্ঞানের অভিধায় এটাই লোকচিকিৎসা নামে পরিচিত।

একালের ন্যায় সেকালে চিকিৎসা বিদ্যা অর্জনের জন্য স্বতন্ত্র কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল না। ১৮৩৫ সালে প্রতিষ্ঠিত কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজ এ ধরনের প্রথম প্রতিষ্ঠান। প্রাচীন মধ্যযুগে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্র হিসেবে প্রচলিত ছিল টোল, চতুষ্পাঠি, মসজিদ ও ইমামবাড়া। এই পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের পাঠ্য বিষয় ছিল কাব্য, নাটক, ব্যাকরণ, অলঙ্কার, ছন্দ, অভিধান, জ্যোতিষ, তর্ক, আগম, পুরাণ, যোগ, ন্যায়, বেদান্ত, ধর্মতত্ত্ব ও ইতিহাস। সঙ্গে থাকতো চিকিৎসা শাস্ত্র। ষোড়শ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে প্রচলিত সম্রাট আকবরের আমলের শিক্ষানীতিতে বিষয়টি স্পষ্টভাবে স্থান পেয়েছে। বিখ্যাত ঐতিহাসিক আবুল ফজল তাঁর “আইন-ই-আকবরী” গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন- "Every boy ought to read books on morals, arithmetic, agriculture, mensuration, geometry, astronomy, physiology, house hold matters, the rules of government, medicine, logic, the tabii, riyazi, science and history of all which may be gradually acquired." "

এ থেকে দেখা যাচ্ছে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে নীতিশাস্ত্র, অঙ্কশাস্ত্র, কৃষিবিদ্যা, জ্যামিতি, জ্যোতির্বিদ্যা, শারীরবিদ্যা, গার্হস্থ্যবিদ্যা, প্রশাসনবিদ্যা, চিকিৎসা, যুক্তিবিদ্যা, তাবীই, রিয়াজী অর্থাৎ কারিগরী, সঙ্গীত, বিজ্ঞান ও ইতিহাস বিদ্যা অর্জন করতে হতো।

এদেশে একদা আয়ূর্বেদী চিকিৎসা শাস্ত্রের ব্যাপক সুনাম ছিল। এছাড়া ছিল ইউনানী ও মঘা শাস্ত্রের ব্যাপক প্রচলন ও জনপ্রিয়তা। জুর, আমাশয়, বাত, মেহ প্রমেহ, যক্ষা, অম্ল প্রভৃতি রোগ নিরাময়ের জন্য লোকেরা আয়ূর্বেদ-ইউনানী, মঘাশাস্ত্র চিকিৎসকদের দ্বারস্থ হতো। এ সব চিকিৎসার ওপর লোকসমাজ যে কিরূপ নির্ভরশীল ছিল তার প্রমাণ মেলে তৎকালীন চিকিৎসকদের লিখিত ‘হেকিমী পুথি', 'কবিরাজী পাতরা” প্রভৃতি থেকে।

উল্লেখ্য যে, হেকিম-কবিরাজ যেই হোক না কেন তাদেরও হয়তো দীর্ঘদিনের শিক্ষা লাভের প্রয়োজন হতো। তাদের অধীত বিদ্যা যে যথেষ্ট প্রশংসনীয় ছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় তাদের গৃহীত চিকিৎসা পদ্ধতি দেখে। কফজ্বর, বাতজ্বর, পিত্তজ্বর, বাত-পিত্তজ্বর, বাত-শ্লেষ্মাজ্বর, পিত্ত শ্লেষ্মাজুর সান্নিপাতিক জ্বর ইত্যাদি প্রকার জ্বর নির্ণয় করতেন চিকিৎসকেরা রোগীর দৈহিক লক্ষণ দেখে। তাঁদের ভাষায় “হস্তপদে দাহ থেকে পিত্তের প্রকোপ; এতে নাড়ীর গতি হয় কাক ও ভেকের ন্যায়; বাতে হয় বক্র; পিত্তে চঞ্চলা শ্লেষ্মায় স্থির মন্দা। রোগীর অবস্থা নিরূপণের জন্য তাঁরা নাড়ীর গতি-প্রকৃতির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করতেন। ভালো চিকিৎসক হতে হলে তাঁকে অবশ্যই নাড়ী বিশারদ হতে হতো। জনৈক চিকিৎসক এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন -

নাড়ীতে বেষ্টিত অঙ্গ জীনের শরীর। সবে বটে ত্রিমুলিকা কহিলেন বীর॥ 

তার মধ্যে সুষুম্না যে মুখ্য নাড়ী জানি। ইড়াতে পিঙ্গলাতে বেষ্টিত রূপে মানি৷ বামভাগে ইড়ারে দক্ষিণেতে পিঙ্গলা তার মধ্যে গড়া নাড়ী সুষুম্না কহিলা॥ ৬

নাড়ী দেখতে হতো রোগীর অবস্থা ভেদে। কোন্ রোগীর কি অবস্থায় নাড়ী দেখতে হবে সে সম্পর্কেও চিকিৎসকের নির্দেশ ছিল -

পুরুষের দক্ষিণে নারীর বাম ভাগে

লক্ষণা-লক্ষণ শুভাশুভ দেখি আগে। স্নাত কিম্বা ভুক্ত কিম্বা ক্ষুধা যুক্ত হয়

নাড়ী দেখা কোন মত “ক’ “খ’ তে নয়। তৃষ্ণাতে কাতর কিম্বা আতব সেবিত শ্রম করি দেহ যার শ্রান্ত অবিরত।

একালেতে নাড়ী যদি দেখএ পণ্ডিত সম্যক প্রকারে নাড়ী (না) হয় বিদিত। ভোজনান্তে-শ্রমণান্তে তৈলভ্যঙ্গে জানি দুর্গমা নদীর ন্যায় নাড়ী শাস্ত্র মানি। এ কারণ সে কালেতে নাড়ী স্থির নয় নাড়ীর বিশেষ বোধ কখন না হয়। শতত পরীক্ষা নাড়ী করিবে পণ্ডিত অঙ্গুষ্ঠ পশ্রিম বাম ভাগে এই রীত।

উল্লেখ্য যে, নাড়ী দর্শনে তৎকালীন চিকিৎসকেরা এমনি পারদর্শী ছিলেন যে নাড়ীর স্পন্দন অনুভব করেই রোগীর মৃত্যুর দিন-ক্ষণ সস্পর্কে ভবিষ্যৎ বাণী করতে পারতেন

মন্দ মন্দ কুটিল নাড়ীর গতি যার পঞ্চম সপ্তম দিনে মৃত্যু হয় তার। অঙ্গুষ্ঠের মূল হইতে দুই আঙ্গুল ছাড়ি সেই স্থানে অনুভব হয় যার নাড়ী। শাস্ত্র মতে এই তার আছে নিরুপম অর্ধ প্রহরে মৃত্যু যেন বিলক্ষণ।

আড়াই আঙ্গুল মধ্যে নাড়ী যদি হয় এক প্রহর পরে মৃত্যু শাস্ত্র মত কয়।” 

আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যাপক প্রসার ঘটায় বর্তমানে আর মানুষ ইউনানী ও মঘা শাস্ত্রের ততটা দ্বারস্থ হয় না। নাড়ী পরীক্ষায় পারদর্শিতা অর্জনের ক্ষেত্রেও চিকিৎসকদের ততোটা মনোযোগ সংযোগ করতে দেখা যায় না।

এদেশে বহুল প্রচলিত একটা কথা আছে - রোগীর চেয়ে চিকিৎসক বেশী'। চিকিৎসকের মনোভাব পোষণে শিক্ষিত-অশিক্ষিত, জ্ঞানী-মুর্খে কোনো ভেদাভেদ নেই। কোনো রোগের কথা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে চার পাশ থেকে শোনা যাবে নানা ঔষধের কথা, দ্রুত রোগ নিরাময়ের তত্ত্বকথা। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও এ ভাবেই সমাজে প্রাচীন কাল থেকে বৈদ্য, ওঝা, কবিরাজ, ধন্বন্তরী নামে পেশাজীবী একটি চিকিৎসক শ্রেণী গড়ে উঠেছে। লোকপরম্পরায় অথবা পারিবারিক ঐতিহ্য সূত্রে প্রাপ্ত জ্ঞানই এক্ষেত্রে তাদের প্রধান অবলম্বন। এ ছাড়া পীর, ফকির, সাধু, সন্ন্যাসীরাও লোকচিকিৎসার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। রোগ নিরাময়ে তারা ভেষজ ঔষধ-পথ্যের পাশাপাশি ঝাড়-ফুঁক, তুকতাক, তাবিজ-কবজ, দারু-টোনা মন্ত্র-তন্ত্রই ব্যবহার করে থাকে।

অতীতে এ দেশে হিন্দু সমাজে বৈদ্য নামে পেশাজীবী একটি শ্রেণী গড়ে উঠেছিল। চিকিৎসাই ছিল তাদের জীবন-জীবিকার প্রধান অবলম্বন। ষোড়শ শতাব্দীর কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর “চণ্ডীমঙ্গল” কাব্যে এদের পরিচয় লক্ষ্য করা যায় -

উঠিয়া প্রভাত কালে উর্দ্ধ ফোটা করি ভালে

বসন মণ্ডিত করি শিরে। পরিয়া লোহিত ধৃতি কাঁধে করি খুঙ্গি পুঁথি

গুজরাটে বৈদ্যজনে ফিরে। 

রোগ নিরাময়ে তাদের প্রধান বিষয় ছিল বটিকা ও তন্ত্র মন্ত্র। বিদ্যা-বুদ্ধি শিক্ষা-দীক্ষায় তারা ছিল অতি নিম্নমানের রোগ নিরাময় তো দূরের কথা অনেক জটিল রোগ দেখে বৈদ্য ছল-ছুতোয় রোগীর নিকট থেকে পালিয়ে আত্মরক্ষার প্রয়াস পেতো। মুকুন্দরামের বর্ণনায় ও দেখি জ্বর শিরো রোগ ঔষধ করয়ে যোগ বুকে ঘাত করে প্রতিজ্ঞায়। দেখিলে অসাধ্য রোগ পালাইতে করে যোগ নানা ছলে মাগয়ে বিদায়।।কর্পূর পাঁচন করি তবে সে রাখিতে পারি কর্পূরের করহ সন্ধান।

রোগী সবিনয় বলে কর্পূর আনিতে চলে সেই পথে বৈদ্যের পয়ান।। সমাজে যারা ওঝা-কবিরাজ নামে পরিচিত তারা অতি ধূর্ত শ্রেণীর মানুষ। লোকমানসকে প্রভাবিত করতে তাদের জুড়ি ভার। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও তাদের অনেকেই অতি পারঙ্গম। লোকসমাজে ভূত, প্রেত, দেও, জীনে বিশ্বাস চিরদিনই প্রবল। এ ক্ষেত্রে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান অচল। কবিরাজেরা অনেকেই রাশি বিশারদ। তারা ভূত, প্রেত, দেও-দৈত্য বিতাড়নের ক্ষেত্রে রাশির ফলাফল বিশ্লেষণ করে; রাশি অনুসারে ঔষধ নির্ণয় করে। কোন্ রাশিতে কোন্ দেওয়ের প্রভাব পড়ে তার পরিচয় প্রসঙ্গে সপ্তদশ শতাব্দীর কবি মুহম্মদ খান তাঁর 'সত্য-কলি-বিবাদ সংবাদ বা যুগ-সংবাদ' নামক কাব্য গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন; মেষে- মহাদেও; বৃষে-বুধে, মিথুনে মহানন্দ; সিংহে- আদর; কন্যাতে ছওদ; তুলাতে- কালা; ধনুতে চিন্দ; মকরে- কসুন; কুম্ভে- আচর্ম এবং মীনে কুঅরি। এ সব দেও বিতাড়নের জন্য ঔষধের উপকরণ ছিলো ময়ূরের পুচ্ছ; অশ্বের কপাল লোম; কুক্কুটের রক্ত ও বিষ্ঠা; ছাগদুগ্ধ; শ্বেত অজার শোণিত; বোয়াল মাছের চামড়া ও পিত্ত; কৃষ্ণ বিড়ালের বিষ্ঠা; চৌপথের মাটি; গাভীর হাড়; গোধন শোণিত ও মূত্র

লোকসমাজে মন্ত্রে বিশ্বাস চিরদিনের। “মন্ত্র হল যাদুবিদ্যার একটি অঙ্গ যা লোকভাষায় প্রকাশ করা হয়”।১২ যাদুবিদ্যা কালে কালে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষের জীবনে গভীরভাবে রেখাপাত করে আসছে। এর প্রমাণ মেলে ইসলামের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন, হিন্দু ধর্মের বেদ-পুরাণ ও সংস্কৃত ভাষায় রচিত কাব্য-শাস্ত্রাদিতে। পবিত্র কোরআনের সুরা আল বাকারা, সুরা আল-আরাফ, সুরা ইউনুস, সুরা হূদ, সুরা বণিইসরাইল, সুরা ত্বোয়াহা, সুরা আম্বিয়া, সুরা আল-ফুরকান, সুরা আশ-শো-আরা, সুরা আন্-নমল, সুরা কাসাস, সুরা সাবা, সুরা আস্-সাফফাত, সুরা ছোয়াদ, সুরা আল মুমিন, সুরা যুখরুফ, সুরা আল-আহকাফ্, সুরা আয্-যারিয়াত, সুরা আত-তূর, সুরা আল্- কামার, সুরা আল-মুদ্দাসির এর বিভিন্ন আয়াতে। ১৩ হযরত মোহাম্মদ নিজেও যাদু শক্তির অনিবার্য প্রভাবের শিকার হন। 'মুসনাদে আহমদ’, ‘সহীহ্ বুখারী' প্রভৃতি তাফসীরে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। 'সহীহ্ বোখারী’তে হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত আছে, 'রসূলুল্লাহ্ এর উপর জনৈক ইহুদী যাদু করলে তার প্রভাবে তিনি মাঝে মাঝে দিশেহারা হয়ে পড়তেন এবং যে কাজটি করেননি তাও করেছেন বলে অনুভব করতেন। একদিন তিনি হযরত আয়েশাকে বললেন আমার রোগটি কি, আল্লাহ্ তাআলা তা আমাকে বলে দিয়েছেন। (স্বপ্নে) দু'ব্যক্তি আমার কাছে আসল এবং একজন শিয়রের কাছে ও একজন পায়ের কাছে বসে গেল। শিয়রের কাছে উপবিষ্ট ব্যক্তি অন্যজনকে বলল, তাঁর অসুখটা কি? অন্যজন বলল, ইনি যাদুগ্রস্থ। প্রথম ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল: কে যাদু করল? উত্তর হল, ইহুদীদের মিত্র মুনাফিক লবীদ ইবনে আ’সাম যাদু করেছে। আবার প্রশ্ন হলো: কি বস্তুতে যাদু করেছে? উত্তর হল, একটি সমাজে যারা ওঝা-কবিরাজ নামে পরিচিত তারা অতি ধূর্ত শ্রেণীর মানুষ। লোকমানসকে প্রভাবিত করতে তাদের জুড়ি ভার। মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও তাদের অনেকেই অতি পারঙ্গম। লোকসমাজে ভূত, প্রেত, দেও, জীনে বিশ্বাস চিরদিনই প্রবল। এ ক্ষেত্রে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান অচল। কবিরাজেরা অনেকেই রাশি বিশারদ। তারা ভূত, প্রেত, দেও-দৈত্য বিতাড়নের ক্ষেত্রে রাশির ফলা-ফল বিশ্লেষণ করে; রাশি অনুসারে ঔষধ নির্ণয় করে। কোন্ রাশিতে কোন্ দেওয়ের প্রভাব পড়ে তার পরিচয় প্রসঙ্গে সপ্তদশ শতাব্দীর কবি মুহম্মদ খান তাঁর 'সত্য-কলি-বিবাদ সংবাদ বা যুগ-সংবাদ' নামক কাব্য গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন; মেষে- মহাদেও; বৃষে-বুধে, মিথুনে মহানন্দ; সিংহে আদর; কন্যাতে- ছওদ; তুলাতে কালা; ধনুতে- চিন্দ; মকরে- কসুন; কুম্ভে- আচর্ম এবং মীনে- কুঅরি। এ সব দেও বিতাড়নের জন্য ঔষধের উপকরণ ছিলো ময়ূরের পুচ্ছ; অশ্বের কপাল লোম; কুক্কুটের রক্ত ও বিষ্ঠা; ছাগদুগ্ধ; শ্বেত অজার শোণিত; বোয়াল মাছের চামড়া ও পিত্ত; কৃষ্ণ বিড়ালের বিষ্ঠা; চৌপথের মাটি; গাভীর হাড়; গোধন শোণিত ও মূত্র।

লোকসমাজে মন্ত্রে বিশ্বাস চিরদিনের। “মন্ত্র হল যাদুবিদ্যার একটি অঙ্গ যা লোকভাষায় প্রকাশ করা হয়”।১২ যাদুবিদ্যা কালে কালে পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষের জীবনে গভীরভাবে রেখাপাত করে আসছে। এর প্রমাণ মেলে ইসলামের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআন, হিন্দু ধর্মের বেদ-পুরাণ ও সংস্কৃত ভাষায় রচিত কাব্য-শাস্ত্রাদিতে। পবিত্র কোরআনের সুরা আল বাকারা, সুরা আল-আরাফ, সুরা ইউনুস, সুরা হূদ, সুরা বণিইসরাইল, সুরা ত্বোয়াহা, সুরা আম্বিয়া, সুরা আল-ফুরকান, সুরা আশ-শো আরা, সুরা আন্-নমল, সুরা কাসাস, সুরা সাবা, সুরা আস্-সাফফাত, সুরা ছোয়াদ, সুরা আল মুমিন, সুরা যুখরুফ, সুরা আল-আহকাফ, সুরা আয্-যারিয়াত, সুরা আত-তূর, সুরা আল্- কামার, সুরা আল-মুদ্দাস্সির এর বিভিন্ন আয়াতে। ১৩ হযরত মোহাম্মদ নিজেও যাদু শক্তির অনিবার্য প্রভাবের শিকার হন। 'মুসনাদে আহমদ', 'সহীহ্ বুখারী' প্রভৃতি তাফসীরে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। 'সহীহ বোখারী’তে হযরত আয়েশা থেকে বর্ণিত আছে, ‘রসূলুল্লাহ্ এর উপর জনৈক ইহুদী যাদু করলে তার প্রভাবে তিনি মাঝে মাঝে দিশেহারা হয়ে পড়তেন এবং যে কাজটি করেননি তাও করেছেন বলে অনুভব করতেন। একদিন তিনি হযরত আয়েশাকে বললেন আমার রোগটি কি, আল্লাহ্ তাআলা তা আমাকে বলে দিয়েছেন। স্বপ্নে) দু'ব্যক্তি আমার কাছে আসল এবং একজন শিয়রের কাছে ও একজন পায়ের কাছে বসে গেল। শিয়রের কাছে উপবিষ্ট ব্যক্তি অন্যজনকে বলল, তাঁর অসুখটা কি? অন্যজন বলল, ইনি যাদুগ্রস্থ। প্রথম ব্যক্তি জিজ্ঞেস করল: কে যাদু করল? উত্তর হল, ইহুদীদের মিত্র মুনাফিক লবীদ ইবনে আ’সাম যাদু করেছে। আবার প্রশ্ন হলো কি বস্তুতে যাদু করেছে? উত্তর হল, একটি চিরুণীতে। আবার প্রশ্ন হল: চিরুণীটি কোথায়? উত্তর হল, খেজুর ফলের আবরণীতে ‘বির যরওয়ান’ কূপে একটি পাথরের নীচে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। অতঃপর রসূলুল্লাহ্ সে কূপে গেলেন এবং বললেন: স্বপ্নে আমাকে এ কূপই দেখানো হয়েছে। অতঃপর চিরুণীটি সেখান থেকে বের করে আনলেন। হযরত আয়েশা বললেন: আপনি ঘোষণা করলেন না কেন (যে, অমুক ব্যক্তি আমার উপর যাদু করেছে)? রসূলুল্লাহ্ বললেন: আল্লাহ্ তাআলা আমাকে রোগমুক্ত করেছেন। আমি কারো জন্যে কষ্টের কারণ হতে চাইনা'। ১৪ মুসনাদে আহমদের বর্ণনায় আছে, রসূলুল্লাহ্র এই অসুখ ছয় মাস স্থায়ী হয়েছিল।

প্রাচীনকালে এদেশের এক শ্রেণীর মানুষের বৃত্তিই ছিল যাদুবিদ্যা দেখিয়ে জীবিকা নির্বাহ করা। এদেরই এক শ্রেণীর মানুষ সাপ ধরতো, সাপের খেলা দেখাতো। এই পেশার সঙ্গে মূলত যুক্ত ছিল ডোম, শবর, পুলিন্দ, নিষাদ, বেদে প্রভৃতি সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষ। সাপের খেলা দেখিয়ে যারা জীবিকা নির্বাহ করতো তাদের কাউকে কাউকে ‘গুণী'” নামে অভিহিত করতো।

সাপুরেরা মন্ত্র বা যাদুবিদ্যার সাহায্যে সাপ ধরতো, সাপের বিষ নামাতো। যারা সাপের বিষ নামানো বিদ্যায় পারদর্শী ছিল তাদের বলা হতো 'ওঝা' বা 'জাঙ্গলিক'। জাঙ্গলিকরা রাজসভায় আসীন হতেন রাজবৈদ্য হিসেবে। ১৮ দ্বাদশ শতাব্দীর সংস্কৃত ভাষার কবি উমাপতিধরের একটি শ্লোকে এক সাপুরের সাপ খেলা দেখানোর পারদর্শিতার কথা বর্ণিত হয়েছে ক্ষুদ্রাস্তে ভুজগাঃ শিরাংসি নময়ত্যাদায় ভ্রাতজাঙ্গলিক ত্বদাননমিলন্নন্ত্রানুবিন্ধংরজঃ জীর্ণস্তেষাফর্ণীন যস্য কিমপি ত্বাদৃগগুণীন্দ্ররজা কীর্ণক্ষ্মাতলধাবনাদপি ভজত্যানম্রভাবং শিরঃ।

ভাই জাঙ্গলিক (সাপুরে) তোমার এই সাপগুলি ছোট ছোট; তোমার মুখের মন্ত্র পড়া ধূলি এদের মাথা নমিত করে দিচ্ছে। এই ফণাধারী সাপটি বোধহয় জীর্ণ (অর্থাৎ প্রবীণ বা অনভিজ্ঞ) কেননা তোমার মতো গুণী দ্বারা পূর্ণ মাটিতে ধাবন করেও এর মাথা নম্রভাব হচ্ছে না।

অতীতের মতো আজও আমাদের দেশে 'গুণী, ওঝা, বৈদ্য, কবিরাজ, পীর, ফকির, সাধু, সন্ন্যাসী, বেদে-বেদেনী, ধাত্রী, শিরালী প্রভৃতি পেশাদার ও অপেশাদার ব্যক্তি মন্ত্র জানেন এবং মন্ত্রের প্রয়োগ করেন। ২০ মন্ত্র গুরুপরম্পরা বিদ্যা। গুরু সাধারণত দিন-ক্ষণ-তিথি দেখে অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শিষ্যকে মন্ত্র প্রদান করে থাকে। আদিতে মন্ত্র ছিল প্রার্থনার অঙ্গ বিশেষ। বৈরী প্রকৃতিকে পরাহত করাই ছিল মন্ত্রের প্রধান লক্ষ্য। একদা যা ব্যবহৃত হতো প্রকৃতির বিরুদ্ধে আজ সেই প্রকৃতিরই উপাচার ব্যবহৃত হচ্ছে মন্ত্র প্রয়োগের ক্ষেত্রে। লোকবিজ্ঞানীরা একেই- Sympathetic Magic, Negative Magic White Magic, Black Magic" ইত্যাদি নামে অভিহিত করে আসছেন।

গুণের তারতম্য অনুসারে মন্ত্রের রয়েছে নানা নাম; যথা- মহামন্ত্র, মূলমন্ত্র ২৩ গুণীমন্ত্র, ২৪ বীজমন্ত্র, ২৫ আড়াইঅক্ষর মন্ত্র, ২৬ প্রভৃতি। মহাজ্ঞান২৭ যার ফলিত ফসল। সর্পদংশিত মৃত রোগীকে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষেত্র এই মহামন্ত্রেরই প্রয়োগ ঘটানো হয়। শ্রীরায়বিনোদের ‘পদ্মাপুরাণ' কাব্যে ওঝা শঙ্খ গাড়ুরী এই মন্ত্র পড়েই সর্পদংশনে নিহত শিষ্যদের পুনরুজ্জীবিত করে তোলেন - সাধন গামছা লৈয়া মহামন্ত্র পড়ি জীয়াইল শিষ্যগণ দিয়া গামছার বাড়ি। 

মন্ত্রশক্তি গুণে শুধু সর্পদংশিত রোগীই পুনর্জীবন লাভ করে না মৃত সৈন্যও পুনরুজ্জীবিত হয়ে ওঠে; ২৯ পাখী মানুষে, মানুষ পাখীতে, ১ রূপান্তরিত হয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে এর যথেষ্ট প্রমাণ পরিলক্ষিত হয়।

প্রাচীন-মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে মন্ত্র ও লোকচিকিৎসা : মন্ত্রের উদ্ভব কল্যাণ বোধ থেকে। ক্ষেত্র বিশেষে তা অকল্যাণেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। লোকজীবনে মন্ত্র প্রয়োগ হয় বিচিত্র অঙ্গনে। জ্বর, রোগ-শোক, স্বামী বশীকরণ, চৌর্য বৃত্তিতে সাফল্য অর্জন, এমনকি যুদ্ধ ক্ষেত্রে শত্রু নিধনেও মন্ত্র শক্তির অমোঘতায় বিশ্বাস করা হয়।

‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র “মহুয়া” পালায় মহুয়ার অসুস্থতায় সন্ন্যাসী অন্যান্য ঔষধের সঙ্গে মন্ত্র প্রয়োগের কথাও উল্লেখ করেছেন

দারুণ আকাল্যা জ্বর হাড়ে লাগ্যা আছে। পরাণে বাঁচিয়া আছে মইরা না সে গেছে৷ শ্বাসেতে ধরিয়া পাতা আন নদীর পানি। এই মন্ত্রে বাঁচাইব তাহার পরাণি॥ ৩২

লোকসমাজের মধ্যেই শুধু নয় উচ্চবিত্তের অভিজাত সমাজও রোগ নিরাময়ে ওঝা-কবিরাজের ব্যবস্থাপত্রে প্রগাঢ় বিশ্বাসের পরিচয় মেলে। “সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল” কাব্যে সয়ফুলের রোগ নির্ণয়ে ওঝা সব সম্বোধিয়া বোলে মহারাজ। তুমি সবে সুস্থ যদি পার যুবরাজ॥ আম্মার ভাণ্ডারে অর্থ আছে এ সঞ্চিত অর্ধ রাজ্য সবে দিয়া করিব পিরীত এই জানি ওঝা সবে হরিষ অন্তর। বহুমন্ত্র পরকার করিল বহুতর॥

পুরুষ শাসিত বাঙালি সমাজে বহুবিবাহ প্রথা চিরদিনের। হিন্দু সমাজে 'কৌলীন্য প্রথা' প্রচলনের ফলে বহুবিবাহ ভয়াবহ রূপ পরিগ্রহ করে। সপত্নী বিদ্বেষানলে নারীর পাতিব্রত্য জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠে। ফলে স্বামী বশীকরণের জন্য বহুপত্নীক পরিবারের রমণীরা ওঝা কবিরাজের দ্বারস্থ হতে শুরু করে।

মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর “চণ্ডীমঙ্গল” কাব্যের ধনপতি উপাখ্যানে তাই সপত্নী বিদ্বিষ্ট লহনা স্বামী বশীকরণের জন্য লীলাবতী দাসীকে বলেছে

আমার লাগুক কড়ি তোর হোক যশ ঔষধ করিয়া মোর স্বামী কর বশ॥

সখী সঙ্গে সঙ্গে বলেছে

আমা হোতে গুণ জান ঝাটে আন জোট পান

সৈয়ার নামে পানে দেব খিলি। সৈয়্যা হই যাইব দাস থাকিব তোমার পাশ

বলিতে না পারিবে মুখ মেলি৷”

এ শ্রেণীর রমণীরা যে তন্ত্র মন্ত্র সিদ্ধা ছিল এর প্রমাণ মেলে বশীকরণের উপাদানিক বৈচিত্র্য থেকে। তারা এক্ষেত্রে ব্যবহার করেছে মেষের নাকের দড়ি, কবরের মাটি, দেউড়ের পার্টি, সাপের আঠালি, রুই মাছের পিত্ত, মৃত গরুর মাথা, এক বর্ণা ধলা গাইয়ের দুধে প্রস্তুত দই, শ্মশানের ফুল, সাপের মাথার আঠুলি কীট, ৩৭ পাখীর পালক, বানরের কানের ময়লা, পূর্ণ হাটের ধূলা, স্রোতোস্বলা নদীর ঘাটের পানি, খাটাশের মাথা, একুশ গণ্ডা কড়ি, কাক চিলের ছানা, কসক ও ধুতরা, চাল চাটি, সতীনের গায়ের ময়লা, ধোরা কাকের জিহবা, প্রভৃতি উপকরণ। দ্বিজমাধবের - ‘মঙ্গলচণ্ডীর গীত’, মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর 'চণ্ডীমঙ্গল', দ্বিজরাম দেবের - ‘অভয়ামঙ্গল' কাব্য পাঠে এমনি ধরনের দ্রব্যাদি ব্যবহারের পরিচয় মেলে।

চৌর্যবৃত্তির সাফল্যের ক্ষেত্রে মন্ত্র ব্যবহারের রীতি চিরকালের বিশ্বাস করা হয় .মন্ত্রপুত মাটি-পানি চুরির জন্য উদ্দিষ্ট বাড়ীতে ছিটিয়ে দিলে সে বাড়ীর সকলে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে; চৌর্যকর্ম নির্বিঘ্নে সমাধান করা সম্ভব হয়। ঘনরাম চক্রবর্তীর - 'ধৰ্ম্মমঙ্গল' কাব্যে লাউসেনকে চুরি করার ক্ষেত্রে ইন্দ্রজালের এমনি ধরনের মন্ত্র ব্যবহারের প্রমাণ লক্ষ্য করা যায়

বর পেয়ে অভয়ে আনিল ইন্দুর মাটি। মন্ত্র পড়ি জাগায়ে ছোঁয়াল সিঁদ কাটি॥ জাগ্‌ জাগ্‌ জাগ্‌ মাটি কাজে লাগ মোর। ময়না নগর জুড়ে লাগ নিদ্রা ঘোর॥ আগম ডাকিনী তন্ত্রে মন্ত্রে পড়ে মাটি। কালিকা দেবীর আজ্ঞা লাগরে নিদুটি৷ লাগ্ লাগ্‌ নগর জুড়ে গড় বেড়ে লাগ্‌ যেখানে যেরূপে যেবা জাগে বীর ভাগ ঘাটে বাটে ভূমে পড়ে যে জন ঘুমায়। ভূপতি ভোজের আজ্ঞা আগে লাগে তায়॥ শয্যায় আসনে শুয়ে বসে যেবা জাগে। ঘোর নিদ্রা নিদুটি নয়নে তার লাগে। চৌকিতে প্রহরায় জাগে আগে লাগ তায়। কাঙ্গুরে কামিক্ষ্যা দেবী চণ্ডীর আজ্ঞায়॥ মাটি পড়ে দিল কুম্ভকর্ণের দোহাই। উড়াইতে শহরে সবার উঠে হাই॥৪০

মন্ত্রে শুধু পরম আরাধ্য স্রষ্টার নিকটই সবিনয় প্রার্থনা থাকে না- লৌকিক দেব দেবীর গুরুত্বও সমধিক ভাবে স্থান পায়। মন্ত্রের কার্যকারিতার জন্য মন্ত্রদাতা দেব দেবীর দোহাই দেয়, ব্যর্থতায় তাদের রূঢ়-অশ্লীল ভাষায় গালি দেয়। চৌর্যবৃত্তির ক্ষেত্রে কালিকা দেবী সবার আরাধ্য; একই সঙ্গে আরাধ্য, তন্ত্রবিদ্যা নিরাময়ক কামরূপের কামিক্ষ্যা দেবী, অমিত শক্তিধর কুম্ভকর্ণ ।

যাদুবিদ্যা তথা ভোজবিদ্যায় পারদর্শী ছিল এদেশের ওঝা-কবিরাজ, পীর ফকির, সাধু সন্ন্যাসী। বিশেষ করে বেদে সমাজের এ ক্ষেত্রে ছিল অপ্রতিহত প্রভাব। তারা লোকসমাজকে মন্ত্রমুগ্ধ করার জন্য তন্ত্রসিদ্ধ রাইচণ্ডালের হাড় ব্যবহার করতো, অমিত শক্তিধর হওয়ার মানসে জীবন্ত সর্পের মস্তক চিবিয়ে খেতো। মৈমনসিংহ গীতিকা'র 'মহুয়া' পালার হুমরা বেদের দলবল নিয়ে কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার প্রাক্কালে ঘটনা বর্ণনায় এর পরিচয় পাওয়া যায় ঘোড়া লইল গাধা লইল কত কইব আর সঙ্গেতে করিয়া লইল রাইচণ্ডালের হাড়।

চিকিৎসায় রাইচণ্ডালের হাড় ব্যবহারের পশ্চাতে রয়েছে অহরসরংস তথ সর্বপ্রাণবাদে বিশ্বাস। বাংলার আদিম জনগোষ্ঠী এখনো সর্ব প্রাণবাদী ধর্মে বিশ্বাসী। এ কালের ন্যায় সেকালেও এদেশের কোনো কোনো ওঝা জীবন্ত সর্পের মস্তক চিবিয়ে খেতে পারতো। কোরেশী মাগনের- “চন্দ্রাবতী" কাব্য পাঠে এর প্রমাণ লক্ষ্য করা যায়

সর্পে মারি মুণ্ডে সেবা করএ ভোজন । মুকুতা ঝরএ মুখে হাসিতে দশন৷

অলক্ষিতে মুণ্ড লই করিল ভোজন। দুগুণ বাড়িল বল রূপ শত গুণ॥

তন্ত্র-মন্ত্র যাদুবিদ্যার মতোই স্থান টোনা বিদ্যার। টোনা বিদ্যার প্রতি সে কালের


লোক- মানসের ছিল প্রগাঢ় বিশ্বাস। টোনাকে অনেকেই অসাধ্য সাধনের শ্রেষ্ঠ পন্থা বলে মনে করতো। “মৃগাবতী" কাব্যের নায়িকা রাজদুহিতা রোকমনি তাই স্বামীকে গৃহে ফিরিয়ে আনার জন্য টোনাকেই একমাত্র অবলম্বন মনে করেছে -

শুনেছি বিসখী বাক্য টোনা বৃথা নহে । 

টোনা করি অন্য দেশ মনিষ্য আনএ॥

 ত্রিভুবন মধ্যে নাই টোনা সম জ্ঞান।

 যাকে টোনা করে সেই নহে অন্য মন৷ 

আমিহ করিলুম টোনা আসিতে কুমার।

না আসিল প্রাণ নাথ উদ্দেশি আমার॥ 

সামদেশের রাজকন্যা আজর হুমায়ুন এর রূপ গুণের পরিচয় প্রসঙ্গে তার টোনা

বিদ্যার পারদর্শিতার কথাও উল্লেখ করেছেন কবি আলাউল তাঁর “সিকান্দারনামা"

কাব্যে -

মহাজ্ঞানী টোনা বিদ্যা নানা গুণ জানে তন্ত্র-মন্ত্রে রূপে হয়ে চতুরের প্রাণে।


এমনকি দেশে অভাব-অনটন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিলেও তার পশ্চাতে টোনার প্রভাব রয়েছে বলে মনে করা হতো। সৈয়দ সুলতান বিরচিত “নবীবংশ" কাব্যে ফেরাউনের মুখনিঃসৃত বাণীতে এমনি ধারণা অভিব্যক্ত হয়েছে -  ভূত-প্রেতে আক্রান্ত রোগীকে নিরাময় করার মন্ত্র ঃ বৌদ্ধ ও হিন্দুধর্ম জন্মান্তরবাদী। জড়বাদী আদিম সমাজের বিশ্বাস-সংস্কারেও জন্মান্তরবাদের ধারণা স্পষ্ট। আৱার অবিনশ্বরতায় বিশ্বাস থেকেই এরূপ ধারণার জন্ম। ভূত-প্রেতের বিশ্বাসের মূলে জন্মান্তরবাদী দর্শনের প্রভাব বহুলাংশে সক্রিয়। লোকসমাজের বিশ্বাস, অপঘাতে মৃত্যু প্রাপ্ত আত্মা অথবা অবৈধভাবে মিলনের ফলে সৃষ্ট সন্তান নিধনের আত্মাগুলো পরিবার সমাজ বেষ্টনীর মধ্যেই অবস্থান করে। তাদের কল্যাণার্থে পূজা অৰ্চনা-দোওয়া-প্রার্থনা করলে তারা প্রসন্ন থাকে অন্যথায় মানুষের অমঙ্গল অকল্যাণে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এই বোধের উন্মেষ ও বিস্তার বাংলার হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রীষ্টান আদিম জনগোষ্ঠী নির্বিশেষে প্রায় সকলের ক্ষেত্রেই বর্তমান।

ভূত-প্রেত নামে কোনো অশরীরী আত্মার অস্তিত্বের কথা কোনো ধর্ম গ্রন্থই স্বীকার করেনা। এ বিশ্বাস অশিক্ষিত স্বল্পশিক্ষিত লোকসমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। একে বাংলার মানুষের আজন্ম বিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবেই চিহ্নিত করা যায়। প্রকৃতপক্ষে ভূত-প্রেত হচ্ছে এদেশের নারী সমাজের সহস্রাধিক বছরের কুসংস্কারের লালিত ফসল। কারণ ভূত-প্রেতের আক্রান্ত রোগী পুরুষ সমাজে ততোটা নেই যতোটা আছে নারী সমাজে। যাদের ভূত-প্রেতে আক্রান্ত রোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তারা মূলত সকলেই মানসিক রোগী। এসব রোগের উৎপত্তি ঘটে শারীরিক দৌর্বল্য, অনিদ্রা-অনাহার, অমূলক ভীতি, মানসিক অবদমন এবং বিরহ জনিত কারণে লোকচিকিৎসকেরা এই শ্রেণীর রোগীর চিকিৎসার ক্ষেত্রে সেবা ঔষধ-পথ্যাদি অপেক্ষা বাহ্যিক প্রয়োগ বিশিষ্ট ঔষধাদির প্রতি অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করে থাকে। তেলপড়া, সরিষা পড়া, জিরা পড়া, চুনপড়া, পানি পড়া, তাবিজ-কবজই যার মুখ্য বিষয়। রোগীকে মানসিকভাবে সতেজ করে তোলার উদ্দেশ্যে তারা আল্লা-রসুল, পীর আউলিয়া, ভগবান-অবতার, লৌকিক দেব-দেবীর সক্রিয় প্রতীকি হস্তক্ষেপ কামনা করে এবং ঝাড়-ফুঁক দিয়ে রোগীর মুখ থেকে তাৎক্ষণিক উপশমের প্রতিক্রিয়া অবগত হতে চায়। ওঝা-কবিরাজের প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসজাত নিরাময়ী মন্ত্র ও উৎসাহ-ব্যঞ্জক বাণী রোগীর মানস জগতে অনুকূল প্রতিক্রিয়া ঘটায়। ধীরে ধীরে রোগীর সুস্থতার লক্ষণ স্পষ্ট হতে থাকে। এক্ষেত্রে ওঝা-কবিরাজের স্বাস্থ্য-সৌন্দর্য, যশ-প্রতিপত্তি রোগীর মনে যথেষ্ট প্রতীতি জন্মায়।

উল্লেখ্য যে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগীরা দুষ্ট ও চরিত্রহীন ওঝা-কবিরাজদের দৈহিক নির্যাতনেরও শিকার হয়। এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে সাধারণত কিশোরী যুবতী নারীদের চিকিৎসার ক্ষেত্রে। অনেক ওঝা-কবিরাজের এ ধরনের কর্মের কথা আমার জানা। ক. তেলপড়া মন্ত্র ঃ ভূত ছাড়ানোর ক্ষেত্রে তেলপড়া, পানিপড়া, সরিষার তেলপড়া পালন করে মুখ্য ভূমিকা। যে সব রমণী বিবাহোত্তর জীবনে পুনরায় তার পূর্ব প্রেমিকের সান্নিধ্য প্রয়াসী তারা স্বামীর পরিবারে এসে নানা প্রকার ভণ্ডামির আশ্রয় গ্রহণ করে। ওঝারা এই শ্রেণীর রমণীদের ভণ্ডামির স্বরূপ সহজেই উপলব্ধি করতে পারে এবং তাদের উপর নানা প্রকার দৈহিক নির্যাতন পরিচালনা করে থাকে। এক্ষেত্রে সরিষার তেল তাদের চোখে প্রবিষ্ট করানো হয় এবং উচ্চারিত মন্ত্রের বাণী

জুড়ায় গেল জুড়ায় গেল

উঠল জোর রোল,

রাম রাম শ্রীরাম শ্রীরাম

লাগল গণ্ডগোল।

উপর থিকা ভূতনী হাকে

মেয়ে ভূতের বাড়ি,

তেল পরাতে অন্ধ হল

ফিরছে গড়াগড়ি।

পায়ে পায়ে পিছলে যায়

যুগিনী যে গরজে,

কালী মাতার বরে

সে যে তরজে তরজে। 

তেল চোখে প্রবিষ্ট হওয়া সঙ্গে সঙ্গে সেই রমণীরা যন্ত্রণাকাতর হয়ে পড়ে এবং তাদের ভণ্ডামি পরিহার করে। এক্ষেত্রে ওঝাদের মন্ত্র গৌণ- তেলই মুখ্য ভূমিকায় পালন করে।

খ. সরিষাপড়া মন্ত্র 

ওঝা এক মুষ্টি সরিষা হাতে নিয়ে এক নিঃশ্বাসে তিন বার পাঠ করে সরিষায় ফুঁ দিয়ে রোগীর শরীরে ছিটিয়ে দেয়। অতঃপর নিম্নোক্ত মন্ত্রটি পড়তে থাকে এবং রোগীর শরীর ঝাড়তে থাকে

এক মুঠা সরিষা বার মুঠা রাই 

চলরে সরিষা তুই কামরূপে যাই।

কায়ের বাড়ী সেই সরিষা পড়িয়া

নরসিংহ ঝাড়ে ধন্বন্তরী হয়া। 

যোজনের ভূত না রয় সেথায়

আগুবাড়ি যাইয়া ভূত দূরেতে পালায়।

সেই সরিষা লয়ে গুরু রামচন্দ্র দিল

ধন্বন্তরী হইয়া রাম ঝাড়িতে লাগিল।

যা অমুকের অংগ হইতে প্রেত শিগ্র করিয়া

না হলে রামচন্দ্র তোরে দিবে ঘা মারিয়া।

কার আজ্ঞে?

 শ্রীরামচন্দ্রের আজ্ঞে ।

 কার আজ্ঞে? 

মন্ত্রগুরু নরসিংহের আজ্ঞে ।

গ. পানিপড়া মন্ত্র: 

ওঝারা তেল সরিষার পরই সাধারণত ব্যবহার করে থাকে

পানিপড়া মন্ত্র। তারা জানে তেলের অপকারিতার কথা। তেল যাতে চোখের কোন ক্ষতি সাধন করতে না পারে, সে কারণে তারা অতি দ্রুত পানিতে মন্ত্র পড়ে রোগীর চোখে অনবরত ছিটা মারতে থাকে। এক্ষেত্রে রোগী চোখ মেলতে না চাইলেও তাকে চোখ মেলতে বাধ্য করা হয়। এ সময় পড়া হয় অতি দ্রুত তালে পানিপড়া মন্ত্র

শিব-শঙ্কর ফিরিয়া পথ ধর

যে পথে আসিলু তুই সে পথেই ফিরাবু মুই

মুই ফিরাচু কালী চণ্ডীর পুত

তুই হে কালী তুই হে ভূত।

কালী চণ্ডীর উপর যদি চড়াব ঘাও,

শিব-শঙ্করের মাথায়

মুছিব দুই পাও ।”


ঘ. ঘি-পড়া মন্ত্র: 

ওঝা যদি বুঝতে পারে রোগীর অসুস্থতার কারণ বায়ুর উর্ধ্বগমণ হেতু সেক্ষেত্রে ঘি পড়ার নির্দেশ দেয়। এক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় নিম্নোক্ত মন্ত্রটি


রাম রতি সীতা সতী

ফান্নার দোষ-দুষী

ভূত-পিশাচ দেও-দেওৱী

খেদাও মা হর পার্বতী।


ঙ. পাতা-পড়া মন্ত্র:

কোনো কোনো ওঝা ভূতে ধরা রোগীকে অপেক্ষাকৃত কম নির্যাতনের উদ্দেশ্যে নিমের ডাল পড়ে রোগীর শরীরে মৃদু আঘাত করে ঝাড়তে থাকে। এতে যেসব রমণী ভণ্ডামীর আশ্রয় নেয় তারা সচেতন হয়ে ওঠে এবং সুস্থতায় ফিরে আসে। এক্ষেত্রে যে মন্ত্রটির প্রয়োগ হয় সেটি হলো শিব-শঙ্কর


ফিরিয়া পথ ধর,

যে পথে আসিবু তুই সে পথে ফিরাচু মুই,

মুই ফিরাচু কালী চণ্ডীর পুত

তুই হে কালী তুই হে ভূত।

কালী চণ্ডীর উপর যদি চড়াবে ঘাও 

রামচন্দ্রের বাণে কাটা যাবে তাও।”

চ. গামছা ঝাড়া মন্ত্র:

ভূতে আক্রান্ত রোগীদের নিরাময়ের জন্য ওঝারা প্রায়শঃই লাল গামছার ব্যবহার করে এবং এক্ষেত্রে তারা সুফলও পায়। ওঝারা একশিরার মন্ত্র পড়ে গামছাকে মন্ত্রপূত করে এবং সেই গামছা রোগীর কোমরে বেধে দিয়ে ঝাড়তে থাকে। এতে রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে। এক্ষেত্রে ব্যবহৃত মন্ত্রটি এরূপ


ধুল ধুল ধুলের পা

বন্দি মাছির চারি পা,

যা মাছি স্বর্গে যা।

স্বর্গ থেকে ফিরে এলে আমার উপর চড়াবে ঘা,

একলাখ ষাট হাজার

দেব-দেবীর মুণ্ডু খা।

শিব বন্দি বন্দি গুরুর পা,

বন্দি কামরূপ কামিক্ষ্যা দেবীর পা। 


ছ. জিরা পড়া মন্ত্র:

ভূত ছাড়ানোর ক্ষেত্রে জিরা পড়া অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা

পালন করে বলে ওঝারা মনে করে

জিরা জিরা মহাজিরা জিরাতো চলে

জিরার শক্তিতে তবে ফলানি ফলে জিরাতে রাম টলে

হামার এই জিরা পড়ায়

উমকার অঙ্গে ভূত না রয়।

কার আজ্ঞে?

পাণ্ডুয়ার পীরের আজ্ঞে। 

জ্বর থেকে নিরাময়ের মন্ত্র:

 জ্বর কোনো রোগ নয়- রোগের উপসর্গ মাত্র। সাধারণত ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, বাত, ভাইরাস প্রভাব এবং দেহের অভ্যন্তরভাগে ক্ষত সৃষ্টি হলেই জ্বর দেখা দেয়। জ্বরে ধমনীতে রক্তসঞ্চালনের গতি বৃদ্ধি পায়। অস্বাভাবিক রক্ত সঞ্চালনের ফলে অনেক সময় মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ ঘটে, নেমে আসে জীবনের চরম পরিণতি।

লোকচিকিৎসায় জ্বর বিশেষ শ্রেণীর একটি রোগ। এ রোগ থেকে নিরাময়ের জন্য ওষুধ-পথ্য ছাড়া ঝাড়-ফুঁক তুক-তাকের সঙ্গে তেল-পড়া, পানি-পড়া এবং বিচি কলা ব্যবহৃত করা হয়। ওঝারা সাধারণত পানি পড়ে রোগীকে তা পান করতে দেয়। পানি পড়ার ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়


জ্বর জ্বর

দিন জ্বর,

রাত জ্বর

হাকুম জ্বর, বিষম জ্বর

ই-জ্বর,

কে ঝাড়ে?

গুরু ঝাড়ে,

গুরু গিয়া মায় ঝাড়ে কামরূপ দেবীর দোহাই লাগে।

উল্লেখ্য যে, সাম্প্রতিক কালে জ্বরের চিকিৎসায় সাধারণত লোকসমাজ ওঝা কবিরাজের ততটা দ্বারস্থ হচ্ছে না। এক্ষেত্রে গ্রামে গ্রামে গড়ে ওঠা হাতুড়ে হোমিওপ্যাথি ও এ্যালোপ্যাথি চিকিৎসকেরাই হয়েছে তাদের প্রধান আশ্রয়স্থল।

শিশুরোগ নিরাময় বিষয়ক মন্ত্র:

এদেশে শিশু মৃত্যুর হার সর্বদাই অধিক। অশিক্ষা-কুশিক্ষা, শিশুকে যত্ন নেয়ার ক্ষেত্রে অজ্ঞতা, বিশেষ করে নবজাত শিশুকে ঘিরে লোকসমাজে অনুষ্ঠিত বিশ্বাস-সংস্কারজাত কিছু আচার-অনুষ্ঠান শিশু মৃত্যুর হার বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

শিশুরোগ নির্ণয় অনেকটাই জটিল। কারণ, শিশুরা তাদের দৈহিক কষ্টের কথা ভাষায় প্রকাশ করতে পারে না। এক্ষেত্রে কান্নাই তাদের ভাব প্রকাশের প্রধান বাহন। পেটের ব্যথা, জ্বর, অজীর্ণ ইত্যাদি কারণে শিশুর কান্না বৃদ্ধি পেতে পারে। লোকচিকিৎসকেরা এ ক্ষেত্রে পানি পড়া, তেলপড়া, নুনপড়া দিয়ে রোগ নিরাময়ের চেষ্টা করে। নবজাত শিশুরা বদহজমের কারণে অনেক সময়ই বমি করে থাকে। কখনো কখনো এর সঙ্গে জ্বর থাকতে পারে। এরূপ ক্ষেত্রে ওঝা-কবিরাজের শরণাপন্ন হলে তারা এসেই মন্ত্র অথবা দোওয়া পড়া শুরু করে -


কান্দিনী মুন্দিনী দুই বহিনী

নদীর জলত ঘর,

এই নাবালগের দেহ ছাড়িয়া

বৈয়কুণ্ঠের পথ ধর।*


এই মন্ত্র পড়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত তিনবার ফুঁ দিলে জ্বর সাধারণত ভালো হয়ে যায় বলে ওঝারা মনে করে। এক্ষেত্রে ওঝারা আরও কিছু মন্ত্রের প্রয়োগ করে। যেমন

ছাড় কান্দিনা

ছাড় থন ছাড়

স্বর্গের পইরী ছাড়

থনশিনী মাথা

কান্দনের রোল,

এই তেল কশাতে

ফন্নার কান্দন

আইজ তুকা পানি হয়্যা

নিন্দত পইল।


এই মন্ত্র পড়ে পানিতে ফুঁ দিয়ে সেই পানি শিশুর দেহে ছিটিয়ে দিলে শিশুর কান্না বন্ধ হয়ে যায়। শিশুদের বমি বন্ধ করার জন্য ‘তেল পড়া কার্যকর ভূমিকা পালন করে। এ প্রসঙ্গে একটা মন্ত্রের উল্লেখ করা যাচ্ছে ।

এই তেল পাঠাইলাম পুরুবও লাগিয়া, পুরুবের বাসুলী দেও দিল পড়িয়া। এই তেল পাঠাইলাম উত্তরও লাগিয়া, উত্তরে ভটকা-ভুটনি দেও দিল পড়িয়া। এই তেল পাঠাইলাম পশ্চিমও লাগিয়া পশ্চিমের সাহাজা দেও দিল পড়িয়া। এই তেল পাঠাইলাম দক্ষিণও লাগিয়া দক্ষিণের গঙ্গাজি দেও দিল পড়িয়া। এই তেল পাঠাইলাম পাতালও লাগিয়া পাতালের বাসুকি দেও দিল পড়িয়া। এই তেল পাঠাইলাম আকাশও লাগিয়া আকাশের বাসুলি দেও দিল পড়িয়া এই তেল পাঠাইলাম পাটুনিক লাগিয়া পাটুনির ঠাকুর দেও দিল পড়িয়া। 

বেজোড় সংখ্যক দিনে এই মন্ত্র পড়ে তেলে ফুঁ দিয়ে সেই তেল শিশুর গায়ে মালিশ করলে জ্বর কমে যায় এবং বমি থাকলে বমিও বন্ধ হয়।

অবসাদে অথবা প্রাকৃতিক নিয়মে অল্প সময়ের মধ্যেই হয়তো শিশু ঘুমিয়ে পড়ে, তার বমি বন্ধ হয়ে যায়। এমনকি জ্বরের ক্ষেত্রেও এমনি প্রাকৃতিক নিয়মেরই কার্যকারিতা হতে পারে। ফলে শিশু নিরাময় হয়ে ওঠে। এতে ওঝা-কবিরাজের গৌরবের কিছু নেই। শিশুদের জীবন নিয়ে এমনি খেলায় মত্ত না হয়ে যে দিন লোকচিকিৎসকেরা লোকসমাজকে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি গ্রহণের পরামর্শ দিবে সেদিনই সমাজের যথার্থ কল্যাণ হবে।

স্তনের ব্যথা-বেদনা নিরাময়ের মন্ত্র : 

সাধারণত প্রসূতিরাই স্তনের ব্যথা-বেদনা জাত রোগের শিকার হয়। দৈহিক গঠন, খাদ্যের গুণাগুণ প্রভৃতি কারণে প্রসূতির স্তনের দুধ উৎসরণ ও প্রতিবন্ধকতা মূলক সমস্যার উদ্ভব ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে পরিবারে অথবা গ্রামের অভিজ্ঞ মহিলা অথবা ধাত্রীরাই প্রাথমিক চিকিৎসকের ভূমিকা পালন করে থাকে। যখন এই শ্রেণীর মহিলারা যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থ হয় তখনই দ্বারস্থ হতে হয় ওঝা-কবিরাজের। স্তনের ব্যথায় ওঝা পড়ে


সাত সমুদ্র শিমলের গাছা

ঐঠে আছে কাকওয়ার বাসা

ছাড়ে দেরে থোনকো

দুধ খাওয়াক বাচ্চা

জাগি জাগি সেই কাম করিস্

যেই তনে লাগাম,

সেই তনে লাগিস।


একদমে তিনবার এই মন্ত্র পড়ে লাঙ্গলের ফালার সঙ্গে লেগে থাকা শুকনো মাটিতে ফুঁ দেয়। অতঃপর সেই মাটি দিয়ে স্তনে আড়াআড়ি ভাবে দাগ টেনে দেয়। এতে স্তনের ব্যথা কমে যায়। উল্লেখ্য এই পদ্ধতিতে চিকিৎসা করার ক্ষেত্রে অসৎ প্রকৃতির লোকচিকিৎসকেরা রোগীর স্তন দর্শন এবং স্তনে হাত দেয়ার মতো অসৎ সুযোগ গ্রহণ করে থাকে। যে সব প্রসূতির স্তনে দুধের প্রবাহ মাত্রাতিরিক্ত হয় এবং নবজাতকের পক্ষে তার সবটা সেবন করা অসম্ভব হয়ে পড়ে সে ক্ষেত্রে স্তন থেকে দুধের নির্গমন ঘটে। এটা কোনো রোগ নয় - প্রাকৃতিক বিধি। স্তনে পেষণ করে অতিরিক্ত দুধ নিঃসারণ করলেই স্তনের অবস্থা স্বাভাবিক হতে পারে। কিন্তু অনেক প্রসূতির নিকট হয়তো এ অভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধতা থাকে। এরূপ ক্ষেত্রেই কখনো কখনো প্রসূতিকে লোকচিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে দেখা যায়। ওঝা বা কবিরাজ রোগীর কাছে এসে মন্ত্র পড়ে

সাত সমুদ্র হেপায়

গাইয়ো করে বাছুর যে করে আয় দুধ উড়ে যা

ফন্নার বুকের দুধ

থাইক্যা যা।


একদমে তিনবার এই মন্ত্র পড়ে স্তনে ফুঁ দিলে স্তনের দুধ পড়া বন্ধ হয়।

অশিক্ষিত সমাজের প্রসূতিরা সর্বদাই শিশুদের তাদের স্তনের দুধ সেবন করায়। এ ব্যবস্থা মহিলা বিশেষে এক থেকে তিন বছর পর্যন্ত চলতে পারে। একারণে অশিক্ষিত সমাজের কোনো মহিলারই সাধারণত স্তনের ক্যান্সার হয় না। তবে অবিবাহিতা এমনকি গর্ভবতী মেয়েদের কখনো কখনো স্তনে টিউমার অর্থাৎ ফোঁড়া হতে দেখা যায়। এই ফোঁড়া ক্যান্সারেও রূপান্তরিত হতে পারে। পঞ্চগড় অঞ্চলে স্তনের এই ব্যাধিকে থনকো বলা হয়ে থাকে। থনকো হলে পড়া হয়

থোনকো থোনকো নোহার কাটি থোনকো ঝাড়া উজান-ভাটি

মহাদেবের আজ্ঞা পা

ফন্নার থোনকো ঘা

শূন্যত যা ।


স্বল্পশিক্ষিত এবং অশিক্ষিত নারীসমাজে স্তনের সৌন্দর্য রক্ষার প্রবণতা নেই বলেই নবজাতকদের স্তনের দুধ দানে বঞ্চিত করেনা। আর এ কারণেই স্তনের নানাবিধ রোগের বিশেষত ক্যান্সারের মতো মরণ ব্যাধির শিকার হতে দেখা যায় না। লোকসমাজের জন্য নিঃসন্দেহে এটা আর্শীবাদ বিশেষ। মাথা ব্যথা নিরাময়ের মন্ত্র শিরোপীড়ায় ভোগেনি এমন মানুষের সংখ্যা সমাজে খুব বিরল। স্নায়ুবিক বিভ্রাট, পারিপার্শ্বিক প্রতিকূল আবহাওয়া এবং মেধার অধিক পরিশ্রমজাত অবস্থার সাময়িক বহিঃপ্রকাশের ফল মাথাব্যথা। আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানে এগুলো সাইনোসাইটিস, মাইগ্রেণ ইত্যাদি নামে পরিচিত।


কপালে প্রচণ্ড ব্যথা হলে

 চিকিৎসক প্রথমেই বিষকপালী নামক একটা গাছের শিকড় উঠায় । শিকড় উঠানোর সময় নিম্নোক্ত মন্ত্রটি পাঠ করা হয়


মাথা মাথা মুর মাথা

এই মাথার বিষ,

কে ঝাড়ে? গুরু ঝাড়ে,

গুরু গিয়া মাই ঝাড়ে।


এক নিঃশ্বাসে তিনবার মন্ত্রটি পড়ে শিকড় উঠায়। তারপর শিকড়টা কপালে চেপে ধরে এদিক থেকে ওদিক তিনবার টানে। সে সময় আরো একটি মন্ত্র পড়তে হয়

আলীর হাংকা

সীতার বাণ, কপালী

অমুকের বিষ কাটিয়া করনু খান খান।

হর বিষ হর, ঝর ঝর নির্ঝর

গোড়লের হুঙ্কার,

হুঙ্কারে ভূমে মাটিতে পর

হেট ছেড়ে উপরে ধাবে দোহাই লাগ ঈশ্বর শিবের

মাথা খাবে


কপালে ঘষা শিকড়টা ফেলে দিতে হয় তিন মাথার মোড়ে। ঐ পথে প্রথম যে যায় সেই আধকপালী রোগের শিকার হয়। এ কারণে শিকড়টি অনেকেই নদীতে বা পুকুড়ে ফেলে দেয়। কপালের ব্যথা তা যে ধরনেরই হোক না কেনো অধিক দিন স্থায়ী হয় না। লোকচিকিৎসকেরা মন্ত্র ও ঔষধ প্রয়োগ করে থাকে একাধিক দিন। তাদের চিকিৎসায় হয়তো মাথা ব্যথা দূরীভূত হয় না- দূরীভূত হয় প্রাকৃতিক নিয়মে। কিন্তু গৌরব প্রাপ্তি ঘটে লোকচিকিৎসকের আর এর ফলেই লোকসমাজ মাথা ব্যথায় অন্য কোনো চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে প্রথমেই ওঝা-কবিরাজের দ্বারস্থ হয়। এ নিয়মের ব্যত্যয় সহজে ঘটবে বলে মনে হয় না। বুকের ব্যথা নিরাময়ের মন্ত্র ঃ ক্ষয় রোগ, হৃদরোগ, ফুসফুসের ক্যান্সার, উর্দ্ধবায়ূ চাপ, পিত্তথলিতে পাথর, বুকে অতিরিক্ত কফ জমা ইত্যাদি কারণে বুকে ব্যথা অনুভূত হতে পারে। এই ব্যথার তীব্রতা ব্যাধির অবস্থাভেদে হের-ফের ঘটতে পারে, ব্যথার স্থায়িত্বেও ঘটতে পারে এমনি ধরনের হের-ফের। বুকে ব্যথা অনুভূত হওয়ার ফলে লোকসমাজের অনেকেই ওঝা কবিরাজের শরণাপন্ন হয়। সে সময় ওঝা-কবিরাজেরা মন্ত্র পড়ে, ঝাঁড়-ফুঁক দিয়ে, তেল পানি দিয়ে রোগ প্রশমনের প্রয়াস পায়। বুকের ব্যথা নিরাময়ের একটি উল্লেখযোগ্য মন্ত্র হলো

হুকরে হুক

তোর বড় দুখ

উদে মারে মাছ

ঝাড়িয়া ফালায় কাঁটা

গুড়িয়া জসু ফেন্নার হুকের ভাষা,

এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয় হুকের বিষ বুকের বিষ

ফেন্নার হয়্যা যা ক্ষয়


এই মন্ত্রটি এক নিঃশ্বাসে তিনবার পড়ে বুকে ফুঁ দিলে বুকের ব্যথা কমে যায়। উল্লেখ্য যে, বুকের ব্যথা জনিত রোগ সম্পর্কে লোকচিকিৎসকদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণেই হয়তো এ বিষয়ে মন্ত্র-তন্ত্রের কম প্রয়োগ ঘটে।

পেটের ব্যথা নিরাময়ের মন্ত্রঅম্ল-পিত্ত দোষ, আমাশা, পাকস্থলীতে পাথর, ফোঁড়া, ক্যান্সার এবং অখাদ্য-কুখাদ্য ভোজনের ফলে পেটে ব্যথা অনুভূত হতে পারে। সাধারণত খাদ্যা খাদ্যে সাময়িক বিভ্রাট জনিত কারণে সৃষ্ট পেট ব্যথা নিরাময় যোগ্য। কিন্তু ক্যান্সারের মতো মরণ ব্যাধির কাছে সকলেই অসহায়। তবু লোকচিকিৎসকেরা এসব ব্যাধির ক্ষেত্রেও নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে না। সাধ্য মতো তারা ঔষধ-পথ্যাদি সহ মন্ত্র, ঝাড়ফুঁক ও প্রয়োগ করে থাকে, যেমন


বাহুকা চিড়ে শিকিয়ে ভাঙ্গে

হর হর বিষ নির্ঝর ঝর

গোড়লের হুঙ্কার

ফেন্নার শরীলের বিষ

আল গোছে পর।


একদমে মন্ত্রটি তিনবার পড়ে তেলে ফুঁ' দিয়ে সেই তেল পেটে মালিশ করলে পেটের ব্যথা নিরামর হয়। আমাশা রোগে দেয়া হয় পানি পড়া আম পরে আম খায়।

কান্দিছ নারে আমাশয়

হিরা দিলাম বাসি জল

আইজ পেটে হবে মল,

রক্ত মুখী রক্ত খা

সাইরা গেছে নাড়ীর ঘা।

সাইরা যা দক্ষিণে পইরা মর সায়রে। 


এক নিঃশ্বাসে এই মন্ত্র তিনবার পড়ে পানিতে ফুঁ দিয়ে সেই পানি রোগীকে পান করতে দেয়া হয়। এই পানি পান করেই রোগী আমাশা রোগ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠে।

আমাশা রোগ নিরাময়ে এই ধরনের পানি পড়া মন্ত্র আরো অনেক রয়েছে

গঙ্গা সাগর তিরপানি

একধারে পরে জানি,

যেই আনে সেই খায়

ফন্নার হাগা-মুতা

প্যাট ফুলা পালায়


বাণ মন্ত্রে আক্রান্ত রোগীকে নিরাময় করার মন্ত্রতন্ত্রসিদ্ধ জীবন সংহারক মন্ত্রই বাণ। বাংলার লোকসমাজে বাণ-ভীতি এখনো প্রচণ্ড। বাণ নানা প্রকার, যথা করাত বাণ, রাম বাণ, জমদগ্নি বাণ, জরি বাণ, পবণ বাণ, কাইল্যাতি বাণ, হীরা বাণ প্রমুখ। এদের মধ্যে শোষোক্ত শ্রেণীর বাণ সবচেয়ে বেশী ক্ষতিকারক।

সাধারণত রক্ত বমন, নাক দিয়ে মস্তিষ্ক থেকে রক্ত ক্ষরণের মতো উপসর্গ বিশিষ্ট রোগীকেই বাণের রোগী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ রোগে আক্রান্ত রোগীকে সুস্থ করার জন্য যেমন বাণ মন্ত্র আছে, তেমনি আছে আত্মরক্ষা মূলক বাণ মন্ত্র। আক্রমণাত্মক জীবন সংহারক বাণ হচ্ছে

(ক) বাণ বাণ

করাত বাণ

রামের বাণ

জমদগ্নি বাণ;

ছাড়ি ছাড়ি

কাইল্যাতি বাণ। 

বাণ শুদ্ধি, বাণ স্থূল

মলি মলি

বাণের ঘায়ে জইল্যা মলি,

কারে বাণ।

রাম গতি বাণ

মহাদেবের ত্রিশূল তাগ্ তাগ্ লাল্ লাগ্

বর্মশেল লাগ যাইয়া;

ব্যাটার কইলজ্যা তুরি

লাগ দেহি,

আয়রে আয়

বীর হুনুমান রাবণ রাক্ষস যার

না মানিল টান;

লাগরে বাণ,

ক্ষেমেঙ্করী কাল

কালা কাল

কাল ক্ষেমঙ্করী যুদি বাণ মিথ্যা যাও দোহাই মা দুইগগ্যার মাথা খাও । 

(খ) যত কিছু বাণ মারে

তালে আর বেতালে,

কলা গাছে বাণ মারে

আপনও গোপালে । 

উঠ কালী বেগে যা যে ব্যাটাকে মারছি বাণ,

 তার বুকেতে বসিয়া কলিজা কর খান খান।

'এ ধরনের বাণে আক্রান্ত রোগীকে নিরাময়ের জন্য প্রয়োগ করা হয় বাণ কাটা


হীরা হীরা হীরার বাদক

হীরায় বাঁধিনু বুক, আসনে বাঁধিয়া বসিনু

চণ্ডী কালীর পুত।

সিতানে জাগে

বীর হনুমান,

শান আর শান, উপরে লোহার বাণ।

শান দিয়া ছত্রিশ কোটি বাণ

হীরা হীরা হীরার বাদক

হীরায় বাঁধিনু বুক, আসনে বাঁধিয়া বসিনু

চণ্ডী কালীর পুত।

সিতানে জাগে বীর হনুমান,

শান আর শান, উপরে লোহার বাণ।

শান দিয়া ছত্রিশ কোটি দেব-দেবতার বাণ,

কাটিয়া করনু খান খান। এই বাণ হেলিব পেলিব

চড়াব ঘাও, দোহাই লাগে শিবের মাথাত মুছিব

যে সব উপসর্গের ওপর ভিত্তি করে কোনো ব্যক্তিকে বাণের রোগী হিসেবে লোকচিকিৎসকেরা চিহ্নিত করে থাকে প্রকৃতপক্ষে সে সব ব্যক্তি সকলেই জটিল রোগের শিকার। সাধারণত এসব রোগে তন্ত্র মন্ত্র, ঝাড়-ফুঁক, তেল-পড়া, পানি পড়া কোনো কল্যাণই বয়ে আনতে পারে না। তবুও লোকসমাজ ওঝা-কবিরাজের দ্বারস্থ হয়, ক্ষেত্র বিশেষে রোগের নিরাময়ও ঘটে।

এমনিভাবে মন্ত্রের প্রয়োগ হয় অর্ধাঙ্গ, আমাশয়, গলাব্যথা, চুলকানি, পাঁচরা, ফোসকা পড়া, বন্ধ্যাত্ব দূরীকরণ, মস্তিষ্কবিকৃতি, মৃগী, শিয়াল কুকুরের দংশিত বিষ, চোখের রোগ, সূতিকা, একশিরা, কলেরা, বসন্ত, ফিক-বেদনা, বাধক, শয্যামূত্র, নিরাপদে প্রসব, হাত মচকা, আঁচলি, বিষাক্ত ক্ষত, শিশুদের ডানা ওঠা, শরীরে পানি ধরাসহ মানব দেহে সৃষ্ট প্রায় সব ধরনের রোগে। একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, লোকচিকিৎসা মানব দেহের রোগ নিরাময়ে যথেষ্ট অবদান রাখতে সক্ষম। লোকচিকিৎসার নানা প্রক্রিয়া, লোকচিকিৎসায় ব্যবহৃত নানাবিধ উপাদান উপকরণ থেকে আমাদের শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে লোকচিকিৎসা পদ্ধতির কার্যকর পদ্ধতিগুলোর স্বরূপ বিশ্লেষণ করতে হবে। কারণ এসবের মধ্যে থেকেও লাভ করা যেতে পারে ভূয়োদর্শনজাত অভিজ্ঞতার মূল্যবান ফসল। পরিশেষে বলা যেতে পারে লোকচিকিৎসা লোকসমাজের জন্য আশীর্বাদ না হলেও অভিশাপ নিশ্চয়ই নয় । মন্ত্র, লোকচিকিৎসা ও লোকধর্ম ঃ বাঙালী একটি রক্ত-সঙ্কর জনগোষ্ঠী। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে বাংলার ভূমিজ সন্তান শবর, পুলিন্দ নিষাদ প্রভৃতি আদিম জনগোষ্ঠীর ওপর অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, মঙ্গোলীয়, নর্ডিক, আলপানীয় বহিরাগত ছোট বড় নানা জাতি জাতির মিশ্রণ বিমিশ্রণ রক্ত-সাঙ্কর্যের প্রাথমিক স্তর নির্মাণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে। অতঃপর রাজশক্তির উত্থান-পতন, আবর্তন-বিবর্তনের সূত্র ধরে পর্যায় ক্রমে শক, হূন, সেন, পাঠান, মুঘল, পর্তুগীজ, ফরাসী, ইংরেজ জাতির এদেশে আগমন অবস্থান রক্ত-সাঙ্কর্যের ধারাকে আরো বেগবান করে তোলো। তন্ত্র-মন্ত্রে বিধৃত বাংলার লোকধর্মে বিচিত্রমুখীন চেতনার যে বিকাশ তার মূলে রয়েছে বাঙালী জাতিসত্তায় বহুজাতিক ধর্মবিশ্বাসের অনিবার্য প্রভাব বাংলার লোকচিকিৎসাবিদ্যা মন্ত্র-তন্ত্র যে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানের ফসল নয়, এটি একটি গুরুবাদী বিদ্যা এ কথা পূর্বেই বলেছি। লোকপরম্পরায় অথবা বংশপরম্পরায় অর্জিত এ বিদ্যাশাখার বিশেষ পরিচয় সর্বধর্মে শ্রদ্ধা। বৌদ্ধের নিরঞ্জন, ধরম্, গোরক্ষনাথ; হিন্দুর ঈশ্বর, মহাদেব, বিশ্বকর্মা, পার্বতী, কার্তিক, গণেশ, মনসা, চণ্ডী, কালী, শীতলা, কামিক্ষ্যা, ডাকিনী, যোগিনী, রাম-লক্ষণ, সীতা, কৃষ্ণ, রাধা, বলাই, চৈতন্য, বিশ্বমিত্র মুসলমানের আল্লাহ্, রসুল, ফেরেস্তা, নবী, আউলিয়া, পীর, দরবেশ প্রভৃতি বৌদ্ধ-হিন্দু-মুসলমান, আদিবাসী নির্বিশেষে সকল লোকচিকিৎসকের সাধন প্রক্রিয়ায় সমান গুরুত্ব পায়। বাংলার ওঝা কবিরাজদের অধিকাংশই জাতিতে বাঙালী। বাঙালীরা ধর্মপরায়ণ না হলেও ধর্মপ্রাণ সকলে । সধর্মে নিষ্ঠা পরধর্মে শ্রদ্ধা তাদের আজন্ম বিশ্বাসের অঙ্গ।

মন্ত্রসিদ্ধ ওঝা-কবিরাজদের কেউ হিন্দু, কেউ মুসলমান। গুরু হিন্দু- শিষ্য মুসলমান; শিষ্য হিন্দু- গুরু মুসলমান। গুরু-শিষ্য ধর্মবিশ্বাসে স্বতন্ত্র হয়েও মন্ত্র সাধনায় অভিন্ন মনা। এ কারণে ভূত ছাড়ানোর সময় মুসলমান ওঝা কছিম উদ্দীনের প্রার্থনা বাণীতে স্থান পায় হিন্দুর কালী, চণ্ডী, বিষহরি দেবীর সঙ্গে মুসলমানের আল্লাহ রসূলের নাম

কালী চণ্ডী বিষহরি হনুমান

ছাড়ি ফের তান ছুচিয়া মাশান

ফান্নার উপর যদি আক্রমণ করি থাক্

যেই পথে আইলি সেই পথে চলিয়া যাক্ দোহাই লাগে আল্লা রসুলের নাম। 


অনুরূপ সাপের বিষ নামানোর ক্ষেত্রে হিন্দু ওঝা রঙ্গলাল দাশের মুখে উচ্চারিত হয় মুসলমান সমাজের মোল্লা কাজীর সঙ্গে হিন্দু সমাজের ব্রাহ্মণী বিষহরির নাম হিন্দুর মধ্যে ব্রাহ্মণী


মুসলমানের মধ্যে কাজী মোল্লা,

বায়ান্ন কোটি সর্পের

মধ্যে খিরত গহমা,

বড় গুই ধরিয়া বলে

বড় চিলা যায়,

যে পায় সে খায়।

হর বিষ হর নির্ঝরে ঝর

যা বিষ তুই পাতাল শহর, রুকমা বিষহরির সহায়।


এক স্রষ্টা, সহস্র নাম। ওঝা-কবিরাজের নিকট তাই আল্লাহ ভগবান অভিন্ন মর্যাদায় আসীন। হিন্দু ওঝা ভূবন মোহন সরকার প্রচণ্ড আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে পথের নিরাপত্তা কামনায় উচ্চারণ করে


থান মান গুরুরও ধিয়ান

তোমার হস্তে ফুলপানি আমাক রাখিছে

আল্লাহ ভগবান


তন্ত্র-মন্ত্রের উৎসভূমি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে আসছে চীন, তিব্বত, কামরূপ । মন্ত্র-তন্ত্র সিদ্ধিদাতা দেবী কামিক্ষ্যার পীঠস্থান কামরূপে অবস্থিত। এখনো কামরূপ, আসাম, বাংলার তান্ত্রিক সাধকদের নিকট শ্রেষ্ঠ দেবী হিসেবে আরাধ্য হয় দেবী কামিক্ষ্যা। সাপের বিষ নামানো থেকে শুরু করে ভূত-প্রেত তাড়ানো, পেট কামড়ানো, বশীকরণের মতো নানাবিধ ক্ষেত্রে ওঝাদের শরণাপন্ন হতে দেখা যায় কামিক্ষ্যা দেবীর; যথা

(ক) সাপের বিষ নামানোতে

খাটু খাটু করলা

লম্বা লম্বা গাছ,

কায় থাকবে বিষ

আমার আচঁলে থাক

আমার আঁচল থাকিয়া যদি

অন্য আঁচল যাস,

দোহাই লাগে মা

ফিরোয়ানে বলে মোর দেশেত মুসা এ। টোনা করি মোর দেশে দুর্ভিক্ষ জন্ম এ॥৫ টোনা বিদ্যায় কি কি সম্ভব সে সম্পর্কে সৈয়দ সুলতান তাঁর “রসূল চরিত”

কাব্যে “ইব্লিসের” বাণীতে বলেছেন –

টোনা কৈলে ভিন্ন নারী ভোলে যত মত।

লেখিল ইব্লিস পাপী করিয়া বেকত॥ এক পুরুষের নারী আন পুরুষেরে। টোনা করি সেই নারী নিতে যেন পারে॥ এ নারী আনের স্বামী যেন হরি নিতে। পত্রেত সে টোনা পাপী লাগিল লেখিতে৷ পুরুষে আনের নারী হরিয়া নিবার। এহি টোনা নারদে লাগিল লেখিবার। কেহ নারী নিজ পতি টোনাএ মারিয়া। ছাড়াইয়া নে পতি লৈ যাএ কাড়িয়া৷ শত্রু ভাবে কেহ কারে নিধন করিতে। এ সকল টোনা পাপী লাগিল কহিতো৷ পুরুষ নপুংসক টোনাএ করিতে। তাহার নারীর সঙ্গে শৃঙ্গার ভুঞ্জীতে৷৷ তান নারী আন সঙ্গে না হৈতে শৃঙ্গার পুরুষে নারীর যোনি বান্ধি রাখিবার৷ এ সকল কুচেষ্টা লেখি একে এক। এ টোনা করিলে যেন হএ পরতেক৷ টোনা করি আপনার নারীর নাম দিল। রসুলের নামে টোনা লেখিয়া রাখিল। ৪৬

মন্ত্র-তন্ত্র ঝাড়-ফুঁকের পাশাপাশি ওঝা-কবিরাজে দেশজ নানা বৃক্ষের লতা পাতা, শিকড় দিয়ে বিভিন্ন আকৃতির বড়ি তৈরী করতো এবং সেগুলো সেবনের জন্য রোগীকে সরবরাহ করতো। কোনো কোনো পেশাদারী ওঝা-কবিরাজ এসব ঔষধ ঝোলায় নিয়ে ঘুরে বেড়াতো। বিজয় গুপ্তের “পদ্মাপুরাণ” কাব্যের গাড়রী ওঝার শিয়রে আছে মোর ঔষধের ঝুলি'র#৭ বর্ণনা থেকে এ তথ্য পাওয়া যায়। ওঝা-কবিরাজের তৈরী এই সব বড়ির অসাধারণ কার্যকরী শক্তি ছিল বলে মনে করা হতো। মনে করা হতো এসব বড়ি সেবন করলে মৃত মানুষও জীবিত হয়ে উঠতো। গাড়রীর কথায় –

বিষ বর্ণ ঔষধ আছে উচলি পৰ্ব্বতে। সেই ঔষধে মরা মানুষ পারি জিয়াইতে॥৪৮

সেকালের সর্পের ওঝা থেকে শুরু করে সকল শ্রেণীর ওঝা কবিরাজই বিষ নাশক ঔষধ প্রস্তুতের জন্য 'বিশল্যকরণী'৪” নামক এক শ্রেণীর লতা বা বৃক্ষের ব্যবহার করতো। এ কারণে যন্ত্রণাকাতর শঙ্খ গাড়রী বেদনা নাশের জন্য পর্বত থেকে বিশল্যকরণী আনয়নের নির্দেশ দিয়েছে। সেই সঙ্গে বর্ণনা করেছে এ বৃক্ষের পরিচয় –

রক্ত বর্ণ ফুল তার রক্ত বর্ণ ফল। বিশল্যকরণী নাম ঔষধি ধবল॥৫১

এ বৃক্ষের বর্ণনা স্পষ্টতর করার জন্য গাড়রী আরো বলেছে –

হরিতাল বন গোড়া পত্ৰ ধবল ।

গাছ সুন্দর তাহার মূল পিঙ্গল॥ 



এতো বর্ণনার পরেও যাতে শিষ্যরা গাছ চিনতে ভুল না করে সে জন্য শঙ্খ মৃতপ্রায় কবুতর সঙ্গে নিয়ে সেই বৃক্ষে লাগিয়ে পরীক্ষার পরামর্শ দিয়েছে –

কৌতর পুড়িয়া লও হাতেত করিয়া। প্রতি গাছে লাগাইও ঔষধ চাহিয়া

জেহি গাছে লাগাইলে কৌতর উড়ে জীয়া রাতারাতি আনিও সেই ঔষধ লইয়া॥৩

এমনি ধরনের এক শ্রেণীর গাছ ছিল যা দিয়ে কবিরাজেরা গর্ভপাত করাতো। অষ্টাদশ শতাব্দীর কবি কৃষ্ণরাম দাসের “কালিকামঙ্গল” কাব্যে এর প্রমাণ রয়েছে। রাজদুহিতা বিদ্যা প্রেমিক সুন্দরের সঙ্গে সংগোপনে মিলিত হওয়ার ফলে গর্ভধারণ করায় কলাবতী ব্রাহ্মণী গিয়ে বিদ্যার কাছে বলেছে –

এমনি ঔষধ জানি কালীর প্রসাদ। নাভিতে বাটিয়ে দিলে গর্ভ হয় পাত॥ ব্রাহ্মণী শুধু গর্ভপাতের ঔষধই জানেনা, সে আরো নানা রোগের চিকিৎসা করে এমনি ধরনের ঔষধ দিয়ে। এ কারণে তার যশ সমস্ত নগরে। ব্রাহ্মণীর পরিচয় দিতে গিয়ে কবি তাই বলেছেন –

কলাবতী নামে এক বাড়ুরি ব্রাহ্মণী 

সেই নগরে বাস 

বঞ্চে একাকিনী কাটা গাছ রাখে

 নিজ ঔষধের গুণে।

নগরের যত লোক তার কথা শুনে॥


গর্ভপাতের ক্ষেত্রেই শুধু নয়- গর্ভ সঞ্চারের ক্ষেত্রেও ওঝা-কবিরাজ সাধু সন্ন্যাসীরা নানা প্রকার ঔষধ প্রয়োগ করতো এবং তাতে আশানুরূপ ফল লাভও সম্ভব হতো। মৈমনসিংহ গীতিকা'র “কাজল রেখা" পালায় আউফুর সাধু হীরাধরের সন্তান লাভ প্রসঙ্গে অমৃত ফলের নাম উল্লেখিত হয়েছে –


অকাল আমিত্তি ফল তুইল্যা দিল হাতে। 

ফল পাইয়া রাধর তুইল্যা লইল মাথে॥

সেই আমিত্তি ফল দিল নিয়া রানীরে।

 মরা পুত্র হইল এক দশ মাস পরে॥


ঝাড়-ফুঁক, তুক-তাকের প্রভাব বাংলার লোকজীবনে চিরদিনই ব্যাপক। ওঝা কবিরাজেরা পান, পানি, ধুলা, গামছা পরে কত রোগ নিরাময়ের যে চেষ্টা করতো তার কোনো ইয়ত্তা নেই।

গুরু গোরক্ষনাথ তাই পুরুষ বশীকরণে পড়া পানের মাহাৱ্য প্রসঙ্গে দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেছে

গুরিক্ষা বলেন কেন সাধিব বিশেষ। পড়া পান পরশে আপনি হবে মেষ॥ ৫৭

পড়ামাটির গুণেই চোর লাউসেনকে নির্বিঘ্নে চুরি করতে সক্ষম হয় –

পড়া মাটি সিদ্ধ কাটি যতোন লইয়া। ময়না ঈশান কোনো উত্তরিল গিয়া॥৫৮

পীর-ফকিরেরা ধূলা পড়েই সকল রোগীকে সুস্থ করে তুলতো এমন প্রমাণ মেলে মৈমনসিংহ গীতিকার" “কঙ্ক ও লীলা” গীতিকা'য় –

নাম ডাকি তার বড় হেকমত। ধূলা দিয়া ভালা করে আইসে রোগী যত ॥ প্রাচীন মধ্যযুগের এই অবৈজ্ঞানিক চিকিৎসা রোগ নিরাময়ে কতটুকু অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছিল তার যথার্থ মূল্যায়ন সম্ভব নয়। তবে অবদান একেবারেই ছিলনা একথাও বলা যাবে না। কারণ মানব দেহের রোগ দু'শ্রেণীর একটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগত (Organic); অপরটি মানসগত (Mental)। মানসিক রোগ নিরাময়ে বস্তুগত ঔষধ পথ্যাদি অপেক্ষা উপদেশ-নির্দেশ, বিধি-নিষেধের কার্যকারিতা অনেক বেশী। সেকালের অধিকাংশ ওঝা-কবিরাজ ছিল বহুদর্শী ও জীবন-বীক্ষায় পরিপূর্ণ। প্রেম-বিরহ, দুঃখ নৈরাশ্য, হতাশা-বেদনায় মানসিক রোগ গ্রস্থ রোগীর কাছে ওঝা-কবিরাজের ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবজ, তেল-জল ছিল উপলক্ষ মাত্র। মূলত রোগীর কাছে চিকিৎসকের অবস্থান সুদীর্ঘ সময়ের নিরীক্ষণ-পর্যবেক্ষণ, প্রয়োজন বোধে আহারে-বিহারে, শয়নে-ভোজনে, স্নেহে-ভালবাসায় বাস্তব সম্মত ব্যবস্থা গ্রহণই ছিল রোগ নিরাময়ের প্রধান দিক। এ ছাড়া মানব দেহের অনেক রোগেরই উৎস-বিলয় ঘটে ঋতু পরিবর্তন, গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান, স্থান পরিবর্তন, খাদ্য-পানীয়ের পরিবর্তন, বয়স পরিবর্তনের অনিবার্যতায়৷ সর্দি, কাশি, হাঁচি, জ্বর, উদরাময়, অম্ল-অজীর্ণ, ক্ষুধা মন্দা, অনিদ্রা, দৌর্বল্য, বিভিন্ন অঙ্গের ব্যথা বেদনা ঘটে প্রাকৃতিক নিয়মে। এসব রোগে লোকঔষধের শরণাপন্ন হওয়া না হওয়া একই কথা। একমাত্র দুরারোগ্য ব্যাধির কাছেই ছিল লোকচিকিৎসকেরা অসহায়। যে ভাবে অসহায় একবিংশ শতাব্দীর মানুষ ক্যান্সার এইডস্ এর ভয়াবহতায়

আধুনিক লোকজীবনে মন্ত্র ও লোকচিকিৎসাঃ সেকালের লোকজীবন ছিল সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার নিগড়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা। শিক্ষা-দীক্ষাও ছিল উচ্চবিত্ত ও বর্ণের মুষ্টিমেয় মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ। স্থবিরতায় আকীর্ণ বাংলার লোকসমাজ শুধু শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা থেকেই বঞ্চিত ছিল না- বঞ্চিত ছিল আর্থ-সামাজিক জীবনের যুগোপযোগী সকল প্রকার নাগরিক অধিকার থেকে। শোষণ-বঞ্চনার শিকার লোকসমাজের বাসনা থাকা সত্ত্বেও সাধ্য ছিল না যোগ্য চিকিৎসকের দ্বারস্থ হওয়ার। কলেরা, বসন্ত, ম্যালেরিয়া, টাইফয়েডের দুর্বার আক্রমণে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে গেলেও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তার কোনো প্রতিকার বিধানের উদ্যোগ গৃহীত হতো না। এসব কারণে বাংলার মানুষের জন্ম-মৃত্যুর হারে সুদীর্ঘ দিন তেমন কোনো তারতম্য ছিল না। মধ্যযুগের ছ'শ বছরে বাংলার জনসংখ্যা স্থিতাবস্থা থেকে যায় এসব কারণে। অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে (১৭৫৭ খ্রীঃ) দেশের রাজতান্ত্রিক ঘুণে ধরা মুসলিম শাসনের অবসান, বেণিয়া থেকে শাসকের ভূমিকায় ইংরেজদের অধিষ্ঠান, শাসন শোষণের ক্ষেত্র সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে দেশে পাশ্চাত্যমুখী শিক্ষানীতি প্রবর্তন, মানব বিদ্যার অন্যান্য শাখার সঙ্গে চিকিৎসাবিদ্যার প্রচলন, লোকমানস বিজ্ঞান ভিত্তিক আধুনিক চিকিৎসা লাভের প্রত্যাশায় উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু এসব শিক্ষাকেন্দ্রের শিক্ষার্থীদে সামাজিক অবস্থান, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের কর্মসংস্থান, সর্বোপরি জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে তাদের সংখ্যা স্বল্পতার কারণে তাদের সেবায় দেশের লোকজীবনে কাঙিক্ষত কোনো কল্যাণই বয়ে আনতে পারেনি। এর ফলে আপদে-বিপদে সহস্রাধিক বছরের চিরাচরিত ব্যবস্থা পীর-ফকির, সাধু-সন্ন্যাসী, ওঝা-কবিরাজের দেয়া ঝাড়-ফুঁক, তুক-তাক, তাবিজ-কবজেই নির্ভরশীল হতে হয়েছে লোকসমাজকে।

লোকচিকিৎসকদের শ্রেণী পরিচয়ে একাল-সেকালে কোনো পার্থক্য নেই। এদের অধিকাংশই অশিক্ষিত অথবা স্বল্প শিক্ষিত। রুপরম্পরা অথবা ংশপরম্পরা শিক্ষাই ছিল তাদের জ্ঞানভাণ্ডারের প্রধান পুঁজি। শঠতা, প্রবঞ্চনা, ধাপ্পাবাজী তাদের অনেকেরই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। লোকচিকিৎসা কোনো কোনো মানুষের জীবন-জীবিকার প্রধান তথা একমাত্র পেশা; কারো কারো কাছে এটা দ্বিতীয় পেশা। বাংলায় সুদীর্ঘ অতীত কাল থেকে আজও বেদে সমাজের এক শ্রেণীর মানুষের মূল পেশাই হলো লোকচিকিৎসা। সাপ ধরা, সাপের বিষ চয়ন ও বিক্রি করা, সাপের বিষ নামানো, দেহের রস-বাত, দাঁতের পোকা খসানো তাদের চিকিৎসার বিষয়। এরা স্বভাবে অনেকেই দুর্ধর্ষ। এর প্রমাণ মেলে ষোড়শ শতাব্দীর শ্রীরায় বিনোদের ‘পদ্মাপুরাণ’ কাব্যের মালিনীর ছদ্মবেশী দেবী মনসার বক্তব্যে –

কেন আইল পসার লইয়া সাপের জে বাদিয়া করে কর মুচরিয়া নিল মোর পসার লুটিয়া। 


লোকচিকিৎসকেরা তাদের চিকিৎসা পদ্ধতির কথা লোকসমাজের কাছে সহজে ব্যক্ত করতে সম্মত হয়না। বিশেষ করে যারা তন্ত্র মন্ত্র, দারু-টোনা নির্ভর চিকিৎসক। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস এসব কথা লোকসমাজে প্রকাশ করলে তার কার্যকরী ক্ষমতা হ্রাস পায়, পেশার ক্ষেত্রে বিপর্যয় ঘটে। এক্ষেত্রে তারা এতোই রক্ষণশীল যে পেশাদারী চিকিৎসক তো দূরের কথা যারা অপেশাদারী তারাও জীবন সায়াহ্নে উপনীত না হওয়া পর্যন্ত তাদের অধীত বিদ্যায় অন্য কাউকে সিদ্ধ করে তুলতে সম্মত হয়না। গুরু অথবা সুফী-সাধক যেই হোক না কেন তারা তাদের শিষ্যদের সুদীর্ঘ দিনের নিরীক্ষণ পর্যবেক্ষণ ব্যতীত কোনো অবস্থাতেই শিষ্যত্বে বরণ করে নিতে চায় না। এই গোপন তথা বাতুনীবিদ্যা দানের ক্ষেত্রে দিন-ক্ষণ-তিথি-নক্ষত্র বিশেষ গুরুত্ব পায়। সাধারণত অমাবশ্যা বিশেষ করে কার্তিক মাসের অমাবশ্যা রজনীই মন্ত্রসিদ্ধির মাহেন্দ্রক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়। লোকচিকিৎসকেরা তাদের পেশাদারী পরিচয়কে বিশেষায়িত করার লক্ষ্যে আহারে-বিহারে, অসনে-রসনে, চলনে-বলনে সর্বদাই কিছুটা স্বাতন্ত্র্যধর্মী। হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে এদের মাথায় থাকে প্রায়শঃই ঝুটি জটা, বাবরী, মুখে দাঁড়ি-গোফ । তেমনি খাদ্যে বৈষ্ণব হলে নিরামিষ শাকান্ন ভোজী শাক্ত হলে মদ্য-মাংস গঞ্জিকা সেবী। ব্যতিক্রম অপেশাদারী পীর আউলিয়া ও মুসলিম শ্রেণী

মানব দেহে ব্যাধির অন্ত নেই; অস্ত নেই তার নিরাময়ের জন্য চিকিৎসা পদ্ধতি ও বিধি-বিধানের। লোকচিকিৎসকেরা সর্ববিদ্যা বিশারদের ভূমিকায় কখনো অবতীর্ণ হয় না। তারাও বিশেষত্বে বিশ্বাসী। কেউ সাপের ওঝা, কেউ বায়ূদোষ নিরাময়ের ওঝা, কেউ বাত-শ্লেষ্মা-জ্বরের ওঝা, কেউ মেহ-প্রমেহ ধাতু দৌর্বলোর ওঝা, কেউ ব্যথা-বেদনা, কেউ খোস-পাঁচড়া, দাদ, একজিমা, হাপানী, যক্ষা রোগের ওঝা, কেউবা কলেরা বসন্তের মতো ভয়াবহ গের ওঝা। লোকচিকিৎসকদের মনের পাতায় বাঁধা রয়েছে এমনি ধরনের শতাধিক প্রকারের রোগ ও তার নিরাময়ের ব্যবস্থা।

বিষয়- বৈচিত্র্যের দিক থেকে মন্ত্র মুলত তিন প্রকার; যথা- (১) আত্মরক্ষা মূলক মন্ত্র, (২) জনকল্যাণ মূলক মন্ত্র ও (৩) জনঅকল্যাণ মূলক মন্ত্র। প্রথম ধারার মন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করা যায়- শরীর-বন্ধন মন্ত্র, গ্রাম-ঘর বন্ধন মন্ত্র, ক্ষেত-বন্ধন মন্ত্র, চোরবন্ধী মন্ত্র, হাতিবন্ধী মন্ত্র; শত্রুকে বশীকরণ মন্ত্র ইত্যাদি। দ্বিতীয় ধারায় পড়ে বিষ ঝাড়া মন্ত্র, ভূত ঝাড়া মন্ত্র, মেঘ নামানো মন্ত্র, বাতাস আনয়নের মন্ত্র, ঝড়-বৃষ্টি তাড়ানোর মন্ত্র, পেচার ডাক বন্ধ করার মন্ত্র, সন্তান প্রসবের মন্ত্র, শিশুর কান্না থামানোর মন্ত্র, মোকদ্দমা নিষ্পত্তির মন্ত্র ইত্যাদি। শেষোক্ত ধারার অর্থাৎ জনকঅল্যাণ মূলক মন্ত্র হিসেবে উল্লেখ করা যায় পিঠা নষ্ট করার মন্ত্র, বর-কনের প্রতি নজর দেওয়ার মন্ত্র, ক্ষেতে নজর দেওয়ার মন্ত্র, রমণী বশীকরণ মন্ত্র প্রভৃতির কথা।

মন্ত্রের প্রকৃতি ও অন্তর্নিহিত ধর্ম বিচারে কেউ কেউ এগুলোকেই – বন্ধন মন্ত্র, বন্দী মন্ত্র, ঝাড়-ফুঁক মন্ত্র, চালান মন্ত্র, আবাহন মন্ত্র, বারণ মন্ত্র, নজর দেওয়া মন্ত্র, বশীকরণ মন্ত্র নামে চিহ্নিত করেছেন।

কোনো কোনো গবেষক মন্ত্রের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বিচারে মন্ত্রকে আত্মরক্ষা, প্রতিকার, লাভ, বিনাশ, বশীকরণ, উদ্ধার প্রভৃতি শ্রেণীতে বিন্যস্ত করেছেন। বিভিন্ন ধারার মন্ত্রের মধ্যে একমাত্র জনকল্যাণ মূলক মন্ত্রকেই লোকচিকিৎসা ধারার অন্তর্গত করা যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে কোন্ কোন্ ব্যাধিতে কোন্ কোন্ মন্ত্র প্রয়োগ করা হয় এবং এসব মন্ত্র প্রয়োগের পদ্ধতিইবা কি, লোকচিকিৎসকদের নির্দেশাদি থেকে তা অবগত হওয়া যায়।

সর্পদংশনে আক্রান্ত রোগীকে নিরাময় বিষয়ক মন্ত্রনদী-নালা, খাল-বিল হাওড়ের দেশ বাংলার অধিকাংশ এলাকা এক সময় বন-বাদাড়ে ছিল পূর্ণ । এতে হাতি, সিংহ, বাঘ, ভাল্লুক, শৃগালের মতো হিংস্র ও ধূর্ত প্রাণীর সঙ্গে সরীসৃপ জাতীয় অনেক প্রাণীরও নিবাস ছিল। বর্ষা-বন্যা-প্লাবনের সময় সরীসৃপ জাতীয় প্রাণীগুলো নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে লোকালয়ে বাসগৃহে ঢুকে পড়তো, এখনো ঢুকে পড়ে। সাপ কখনো কাউকে তেড়ে এসে দংশন করে না। কিন্তু অসতর্কে অসাবধানে লোকচক্ষুর অন্তরালে সাপের দেহের ওপর কোনোরূপ আঘাত পড়লে সঙ্গে সঙ্গে সাপ ছোবল মেরে বসে। এর ফলে সর্পাঘাতে অতীত কাল থেকে অদ্যাবধি প্রতি বছর বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে অনেক মানুষের জীবন সংহার ঘটে।

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের কল্যাণে সাপের বিষ নাশের ওষুধ আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু এখনো লোকসমাজে সাপে কামড়ানো রোগীর চিকিৎসায় ওঝা-কবিরাজে যতো বিশ্বাস, আধুনিক চিকিৎসায় ততোটা বিশ্বাস গড়ে ওঠেনি। সর্পদংশনে অসুস্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এ্যালোপাথী চিকিৎসকের বা হাসপাতালের দ্বারস্থ না হয়ে ওঝা-কবিরাজের শরণাপন্ন হয়। ওঝা-কবিরাজেরা তাদের সীমিত জ্ঞানের ঝুড়ি নিয়ে ঝাড়-ফুঁক, মন্ত্র-তন্ত্র দিয়ে রোগীকে সুস্থ করার জন্য সচেষ্ট হয়ে ওঠে। তারা ডুরবন্ধন মন্ত্র, চাপট সাধন মন্ত্র, হাত চালান মন্ত্র, থালা লাগানো মন্ত্র, গামছা ঝাড়া মন্ত্র, রুমাল ঝাড়া মন্ত্র, বিষবন্ধন মন্ত্র, বিষবন্ধন কাটানো মন্ত্র, চূন পড়া মন্ত্র, মুরলী ঝাড়া মন্ত্র, গাইটালী বিষ ঝাড়া মন্ত্রের মতো নানা প্রকার মন্ত্র পড়ে রোগীকে সুস্থ করে তুলতে সচেষ্ট হয়। সর্পদংশিত রোগীকে নিরাময় করে তোলার ক্ষেত্রে ওঝারা যে কত বিচিত্র প্রকারের পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে বিভিন্ন প্রকার মন্ত্র প্রয়োগ প্রসঙ্গে তার পরিচয় উপস্থাপন করা যাচ্ছে।

ক. ডুর বা গাঁট বন্ধন মন্ত্রঃ

 সাপ শরীরের যে স্থানে দংশন করে সেখান থেকে যাতে অতি দ্রুত বিষ দেহের অন্যান্য অঙ্গে বিস্তার লাভ করতে না পারে সেজন্য যথাসত্বর দংশিত অঙ্গের সামান্য ওপরে রশি দিয়ে শক্ত করে বাঁধা হয়। সে সময় পড়া হয় -


ডোর ডোর গাঁটের ডোর

থাক বিষ পইড়ে তোর,

আমি যাই ঈশ্বর

মহাদেবের সেবা কর,

দোহাই মা পদ্মার দোহাই মা জরৎকার।


খ. চপেট সাধন মন্ত্র : সাপে কামড়ানোর পর রোগীর পক্ষ থেকে যে লোক ওঝার বাড়ীতে খবর দিতে অথবা ওঝাকে ডাকতে যায়- ওঝার বাড়ীতে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ওঝা একটি মন্ত্র পড়ে তার গালে অথবা পিঠে একটা চড় মারে। সাধারণের বিশ্বাস ওঝা চড় দেবার সঙ্গে সঙ্গেই রোগী সুস্থ হয়ে ওঠে। ৬৪ চাপট সাধন মন্ত্রে

উচ্চারিত হয় –

ধরতো এই ধরণী

দংশিল কাহারে ফনী

ধরণীর ধর বিষ কেনরে এত বিষ ।

এ গোমার থাকবেনা

চাপর খেয়ে চলে যা,

বিষহরির বিষম আজ্ঞে

মা মনসার আজ্ঞে । 


কোনো কোনো ওঝা সর্প দংশনের সংবাদ শ্রবণের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ীতে বসেই রোগীর উদ্দেশ্যে বিষ বন্ধের মন্ত্র পড়ে নেয়


ডালিম কুটকুটে বিষ

যায় হারে হারে

ফান্নাক কামড়াইল সর্পে

আমার বিষ মুষ্টে

পদ্মা সংহারে

বিষ যা তুই পাতাল শহরে। 

গ. হাত চালান মন্ত্রওঝা রোগীর কাছে এসে প্রথমেই রোগীর দেহের বিষের শ্রেণী ও অবস্থান নির্ণয়ের চেষ্টা করে। অর্থাৎ রোগী আদৌ সর্প দংশনে আক্রান্ত কিনা তা পরীক্ষা করে দেখে। এ জন্য প্রথম সে যে মন্ত্র প্রয়োগ করে তাকে হাত চালান মন্ত্র বলে –


ধরম চালু করম চালু

ছয়কুড়ি মাশান চালু

নয়কুড়ি কালী চালু

ওরে হাত তোরে চালু

বিষ থাকলে সম্মুখে চল

বিষ না থাকলে ডাইনে বামে চল। 


এই মন্ত্র পড়ার পর যদি হাত না চলে তবে বুঝতে হবে রোগীকে সর্প দংশন


করেনি। আর যদি বুঝতে পারে রোগীকে বিষাক্ত সাপ দংশন করেছে তখন ওঝা “বাম হাতের তালু মাটির ওপর রেখে মন্ত্র পড়ে সেই হাতের ওপর ফুঁ দেয়। এভাবে তিনবার মন্ত্র পড়ে তিনবার ফুঁ দিলেই হাত উপরে চলতে থাকে এবং শরীরের যেখানে বিষ আটকে থাকে হাত সেখানে যেয়ে স্পর্শ করে থেমে যায়। এরপর ওঝা পড়ে –


চাল কাটে চালোয়ান

বীর হনুমান পালোয়ান,

হাত চলে আর পবন চলে

দেব মহাদেব সাথে চলে,

চলরে হাত শিগ্র চল

যদি না চলিস

তাতে হবে নালিশ,

কার আজ্ঞে? বিষহরির আজ্ঞে,

মা মনসার আজ্ঞে ।


ঘ. থালা লাগানো মন্ত্র

এই মন্ত্র পড়ে ওঝা সাপে কামড়ানো রোগীর পিঠে একখানি কাঁসার থালা লাগিয়ে দেয়। থালাখানি পিঠের উপর এমনভাবে থাকে যে, কোনক্রমেই আর রোগীর পিঠ থেকে পড়ে না। তারপর শরীরের সমস্ত বিষ নেমে গেলে থালাটি রোগীর পিঠ থেকে পড়ে যায়”। ওঝা উচ্চস্বরে পড়তে থাকে –


থালি থুলি আন্ধার আতি

না জানি সর্প কোন জাতি, জাতি হইল মহালতি

হররে বিষ হর

পঞ্চমে পড়ে মর

ঙ. গামছা ঝাড়া মন্ত্র ঃ এই মন্ত্রটির ব্যবহার এদেশে সুপ্রাচীন কাল থেকে চলে আসছে। “সাপে কামড়ানো রোগী যখন কোনো রকমে আরোগ্য লাভ করতে চায়না তখন ওঝা হাতে গামছা নিয়ে রোগীকে ঝাড়া আরম্ভ করে ও মন্ত্র শেষ হলে রোগীর গায়ে গামছা দিয়ে মৃদু আঘাত করে। মন্ত্রপুত গামছা দিয়ে রোগীর গায়ে আঘাত করলে শরীরের বিষ গামছায় উঠে আসে”।92


এস্ বন্দি আইয়েরে বিষা রহলে ছাপাই হ্যায়, গামছা ছে ঝাড়ে বিষা

পল্লব ছে ঝাড়ি হ্যায়, নিমক ডালে তোরে গে দেবী


উনলু ছে ছাড়িব, ঝাড়িতে ঝাড়িতে রে বিষা বাইয়া থাকিয়া গেইল্, তেও না নাবিল নারে বিষা মানুষের অঙ্গে আইল্ গোড়লে হাঙ্কারে দেব গোরেস্ত বাহার আইল্ আনিব গোড়লের পাঙ্খা মারিব ঝিকরের ঝাণ্ডা, তিন ঝাণ্ডা মারে বিষা চালিয়ে চালিয়ে হ্যায়। কপাল বান্দি আইয়ে বিষা রহলে ছাপাইয়ে হ্যায়।


চ. রুমাল ঝাড়া মন্ত্রঃ

'সাপে কামড়ানো রোগীর শরীর থেকে বিষ ঝাড়ার জন্য ওঝা এক নিঃশ্বাসে রুমালে একটি গিঠ দেয়। তারপর সেই মন্ত্রপুত রুমাল দিয়ে রোগীকে ঝাড়া শুরু করলে রোগীর সমস্ত শরীরের বিষ রুমালে উঠে আসে ও অল্প সময়ের মধ্যে রোগী আরোগ্য লাভ করে। এই মন্ত্রটি প্রকৃতপক্ষে গামছা ঝাড়া মন্ত্রেরই নামান্তর। ওঝা রুমাল নাড়ে আর পড়ে -


রুমাল পড়ম রুমাল পড়ম

রুমাল পড়ম সার

রুমালের উপর বিষ নাই আর।

হেটে বসুমতি উপরে চান

মুই দিলুম রুমালের বাণ। যুদি বিষ হেট ছাড়ি উপর বঅছ

ছত্রিশ কোটি নাগিনীর মাথা খঅছ

দোহাই আল্লার । 


ছ. মূরলী ঝাড়া মন্ত্রঃ

“মূরলী অর্থ বাঁশী। রোগীকে সাপে কামড়ালে অনেক ক্ষেত্রে ওঝা বাঁশী বাজায় ও রোগীর শরীর থেকে বিষ নামানোর চেষ্টা করে। যে সাপ রোগীকে দংশন করে সে যেখানেই থাকুক না কেনো বাঁশীর সুরে সেই রোগীর কাছে ছুটে আসে ও ক্ষতস্থানে মুখ দিয়ে রোগীর দেহের বিষ তুলে নেয়। রোগী আরোগ্য লাভ করার সঙ্গে সঙ্গে সাপটি মারা যায়"। ৭৬ এই পদ্ধতিতে বিষ নামানোর ক্ষেত্রে এদেশের পেশাজীবী ওঝা বেদে সম্প্রদায়েরই অধিকতর সাফল্যের পরিচয় লক্ষ্য করা যায়। ওঝা কি ভাবে সাপকে আহবান করে ?

কোণেতে বসিয়া লখিন্দর

বেউলা বসি ঘরে,

উভয়েতে চরখা কাটে

হাত পা নেড়ে নেড়ে।

ওরে বিষ তোরে আমি জানি

খেয়েছিস স্বামীরে মোর

তুই শত খাউনী। না হোক ওরে বিষ

তোরে করি নমস্কার,

আমার গিহেতে তুই

না আসিস আর বার।

যাবি শিগ্র যা না হলে মা মনসার মাথা খা। কার আজ্ঞে?

কামরূপ কামাক্ষ্যা মায়ের আজ্ঞে ।

কার আজ্ঞে?

মা মনসা দেবীর আজ্ঞে। 


জ. বিষ বন্ধন ও বিষ খণ্ডনের মন্ত্রঃ 

অনেক সময় এক ওঝা অন্য ওঝার ওপর প্রাধান্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে প্রতিপক্ষ ওঝার বিষ নামানো বন্ধ করে দেয়। এর ফলে অনেক রোগী মারা যায়। বিষ বন্ধের জন্যে সাধারণত ব্যবহৃত হয়


ধুলায় ফোটা

ধুলায় লোটা, কুণ্ঠে যাইস

বাইশ নাংয়ের ব্যাটা।

যাইস লোহার শিকরে

অধমো বাশুকীর ধুলার বন

যদি কেটে যাব,

ঈশ্বর মহাদেবের

মাথা খাব। 

বিষ খণ্ডণের জন্য অনুরূপ ব্যবহৃত হয় –

নদীতে বেল গাছ

বেলাতি পাত

সব চিতে ডুব মারে

কালের সাত।

উপর কালী

কান কান হেড কালী,

শেরমলি কানমলি

আট কূট সময়ে যাই

দোহাই গাড়ুলের দোহাই মা মনসার।


ঝ. পাতা-পড়া 

মন্ত্রসাপের বিষ নামানোর জন্য ওঝারা নিমপাতা, শিমুলপাতা, বেলপাতা, জিগাপাতা, বাঁশপাতা ব্যবহার করে থাকে। যেমন

(ক) হোলি হোলি বিষতে বিষতে পতি মুই না জানু বিষ আছে
কোন্ কোন জাতি
বসুয়া, খসুয়া, বড়ুয়া, কছুয়া হারকে
চেক চেক হে চেক চেক
হেট ছেড়ে বিষ উপরে ধাইস
কাল যোগিনীর মাথ খাইস
হর বিষ হর কোরোলে হুঙ্কার বিষ
জমিতে পর।


(খ) একখানি পুকুরি চারিখানি ঘাট,

তাহাতে উপজিল পদ্মারও পাত

পদ্মার পাতোতে উপজিল পদ্মাকুমারী

বাপ মায়ে নাম থুল জয় বিষহরি।

হর বিষ হর নির্ঝরে ঝর

গড়ুলের হাংকারে বিষ যা তুই

পাতালপুর শহর। 

(গ) সাত শিমুল এ্যাকা ব্যাকা

তাই পরিল গড়ল পাখা, যখন গড়ল হেকে হুকে

তিন জনমের বিধ

ধরিতরির পর,

নাম নাম ফান্নার বিষ চাপি মারম,

গড়লের হাংকারে বিষ

পাতাল পর


ঞ. কাদামাটি পড়া মন্ত্র 

ওঝারা বিষক্রিয়া প্রশমিত করার উদ্দেশ্যে কখনো কখনো রোগীর সমস্ত শরীরে কাদামাটি মেখে মন্ত্র ঝাড়ে, কখনো কখনো ধুলোমাটি পড়ে সে ধুলো রোগীর শরীরে মালিশ করে দেয় এবং মন্ত্র পড়ে ঝাড়তে থাকে। যেমন—


(ক) দেবায় বলে দেবী গো

কি করগো বসিয়া তোমার শিব চৈতন্য অইছে

চেতন করগো আসিয়া।

শিবের মুখে দিলাম চূন,

ভাংলাম কালকুটি বিষের ঘুম

ও পাড় মহাদেব খাকেক করে খায় বিশাইলা নাগের বিষ

মারলাম পোছনের গায়।

ও বিষ, ওরে নির্ঝরের জ্বর

মহাদেবের চাপে বিষ

ভষ্ম কর

(খ) বিষ বান্দু রসে

বিষ বান্দু কষে

কি বিষ বান্দু নাগের ফাঁসে,

কাহার আজ্ঞে?

দোহাই মহাদেবের আজ্ঞে।"

ট. চূন পড়া মন্ত্র :

 ক্ষেত্রে বিশেষে ওঝারা মন্ত্র পড়ে চূনকে মন্ত্রপূত করে এবং সেই চূন সর্প দংশিত স্থানে প্রলেপ দিয়ে বিষ প্রশমনের প্রয়াস চালায় চূন চূন এই চূন


হেলব ফেলব

চড়াব ঘাও,

আস্তে গুণে

মাথায় মার

দুই পাও।

কে বান্দে?

গুরু বান্দে,

বান্দায় সারি

দোহাই বান্দে। 

দেশে এখনো অসংখ্য প্রকারের সাপ আছে, সাপের মন্ত্র আছে, ওঝা-কবিরাজ আছে। নেই শুধু বিষাক্ত সাপের দংশন থেকে জীবন রক্ষার কোনো যোগ্য মন্ত্র নির্বিষ সাপের দংশন থেকে মানুষ সহজে সুস্থ হয়ে ওঠে বলেই লোকসমাজে ওঝা-কবিরাজের সুযশ ছড়িয়ে পড়ে। অথচ বিষাক্ত সাপের দংশনেই অনেক সময় ওঝা-কবিরাজেরই জীবন সংহার ঘটে। ২৫ জুলাই, (২০০০) দৈনিক প্রথম আলো' পত্রিকায় এই তথ্যই পরিবেশিত হয়েছে। ঈশ্বরদীর প্রতিনিধি জানাচ্ছে- 'সাপের কামড়ে ঈশ্বরদীতে গত ২৩ জুলাই শাজাহান (৩৫) নামে একজন সাপুড়ের মৃত্যু ঘটেছে। তার বাড়ি ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার গঙ্গাধরদী গ্রামে।

বেদের বহর নিয়ে শাজাহান এসেছিল ঈশ্বরদীতে। সে প্রতিদিন তিন-চারটি সাপ খেয়ে নেশা করত। বেদেরা জানায়, দীর্ঘ ১৩ বছরের সাপুড়ে জীবনে শাজাহান ৭ হাজারের বেশি সাপ খেয়েছে। গত প্রায় এক মাসে শাজাহান ঈশ্বরদীর বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ১ হাজার বিষধর সাপ ধরেছিল বলে জানা গেছে। এ জন্য ঈশ্বরদীতে সে বেশ পরিচিতি লাভ করে।

প্রত্যক্ষদর্শী এবং বেদেরা জানায়, ২৩ জুলাই সকালে একটি বিষধর সাপ নিয়ে খেলার সময় তাকে ওই সাপ দংশন করে। বিষয়টি গুরুত্ব না দিয়ে সে কয়েকটি কাঁচা মরিচ চিবিয়ে বলে, আমার কিছুই হয়নি। এর কয়েক ঘণ্টা পর তার অবস্থা বেগতিক দেখে হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। এতেও শেষ রক্ষা হয়নি। সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।'

মন্ত্র বা যাদুশক্তির প্রতি লোকসমাজের সুগভীর শ্রদ্ধা ও অটল বিশ্বাস থাকা সত্ত্বেও এ বিদ্যা যে সকল ক্ষেত্রে সাফল্য দেখাতে সক্ষম হয় না উপরোক্ত ঘটনাই তার প্ৰকৃষ্ট প্রমাণ। মনসার মাথা খাস। কার আজ্ঞে? মা মনসার আজ্ঞে কামরূপ কামিক্ষ্যার আজ্ঞে।'

(খ) দাম্পত্য জীবনে সম্প্রীতি সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে

সিন্দুর সিন্দুর চিনা সিন্দুর আমার সিন্দুর পরা

ফন্নির কপালে দিলে ফোটা

ফন্নার হবে বোকা পাঠা

কার আজ্ঞায়?

কামরূপ কামুক্ষ্যার আজ্ঞায়।

আমার সিন্দুর পড়া

যদি লঙ্ঘন হয়,

ঈশ্বর মহাদেবের মাথা

মুছি দিব দুই পা।

চিলিং চিলিং লিং লিং সহায়।

আমার এই পান পড়া

অমুকীকে লাগ কার আজ্ঞে ?

কাউরের কামাক্ষি মায়ের আজ্ঞে।

মোহিনী মোহিনী রাজমোহিনী

মাই মোহিনী জানো,

পাঁচ দেব পাঁচ দেবীতে

ডাক দাও না কেনো।

রাক্ষস রূপে বইসো বেটি রাক্ষসের বান্দি পাও,

শীরকালী বীরকালী

ঐ লোকটার শরীলে লাগিয়া যাও।

কার দোহাই?

মা কামরূপ কামাক্ষ্যার দোহাই।

(ঘ) পেট ব্যথা নিরাময়ে

নুন নুন কোন নুন?

পুরুব নুন পচিম নুন, 

উত্তর নুন দক্ষিণ নুন, 

আলা নুন পালা নুন, 

এই নুন কে পড়হায়?

গুরু পড়হায়,

গুরু গিয়া মাই পড়হায়, 

পড়ায় সারি কারি গিয়া কামরূ কামিক্ষ্যা, 

দোহাই গুরু দোহাই পড়হায়৷


(ঙ) বাতের ব্যথা নিরাময়ে

ব্যথা ব্যথা মোর ব্যথা

মাথা ব্যথা গাও ব্যথা,

পিঠি ব্যথা কোমরত ব্যথা

মাজার ব্যথা ঠ্যাংনা১২৯ ব্যথা,

গাইটা ব্যথার বিষ কে থামায়?

শ্রী হরির জ্ঞিয়ান থামায়। কামরূপ কামিক্ষ্যার দোহায়। 

(চ) ভূত ছাড়াবার ক্ষেত্রে

ধুল ধুল ধুলের পা

বন্দী মাছির চারি পা,

যা মাছি স্বর্গে যা

স্বর্গ থেকে ফিরে এলে

আমার উপর চড়াবে ঘা, এক লাখ ষাট হাজার

দেব-দেবীর মুন্ডু খা,

শিব বন্দি বন্দি গুরুর পা কামরূপ কামিক্ষ্যা দেবীর পা। ১১৮

(ছ) চোখ ওঠা ঝাড়নে

আয় শূল কুন্ঠে গেইল? এই চোখ ঝাড়ি গেইল,

আয়ে কালী কামিক্ষ্যা দেবী

তুই মোর মাও

চিলিং ভ৷ কিলিং কিষ্টের সহায় দুর্গা দেবীর মাথা খাও।

প্রকৃতপক্ষে লোকচিকিৎসকেরা আল্লাহ্-ঈশ্বরকে স্বতন্ত্র নামেই শুধু আখ্যায়িত করে; ভক্তি করে অভিন্ন দৃষ্টিতে। দেশ ভেদে, স্থান ভেদে, কাল ভেদে, ব্যক্তি ভেদে স্রষ্টার নামের ভিন্নতা ছাড়া স্রষ্টার ক্ষমতায় কোনো ভিন্নতা নেই। এই উদার ও বিশ্বজনীন দর্শনে বিশ্বাসী লোকসমাজ, লোকমানস বাউল সাধক লালনের সাধনায় লৌকিক সমাজের এই বিশ্বজনীন চেতনার বাণীই যেন ধ্বনিত হয়েছে স্পষ্ট ভাবে আরবী ভাষায় বলে আল্লা ফারসীতে কয় খোদা তা লা গড বলিছে যীশুর চ্যালা ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভাবে। আল্লা হরি ভজন-পূজন এ সকল মানুষের সৃজন অনামক অচিনায় বচন

বাগিন্দ্রিয় না সম্ভবে। ওঝা-কবিরাজেরা ব্যক্তিজীবনে যে ধর্মাবলম্বীই হোক না কেনো পেশাগত পরিচয়ে তারা চিকিৎসক। লোকহিব্রতই তাদের পেশার প্রধান লক্ষ্য। তাদের কাছে রোগীর পরিচয় ধর্মে নয়- রোগে; রোগীর সংগে তাদের সম্পর্ক দাতা-গ্রহিতার ভূমিকায় নয়; সেবায় শ্রদ্ধায়, কল্যাণে সম্মানে।

মন্ত্র ও কবিতাকবি-মানসের অখণ্ড ভাব ও রূপময় বাঙ্ময় অভিব্যক্তিই কবিতা। ভাব গভীরতা কবিতার প্রাণ; ছন্দ, অলঙ্কার ও ভাষার কারুকার্যতা তার অঙ্গ সৌষ্ঠব। চূড়ান্ত বিচারে রসময়তা ও সৌন্দর্য সৃষ্টিই কবিতার লক্ষ্য। কিন্তু মন্ত্রের উদ্দেশ্য ভিন্ন। আঙ্গিকের দিক থেকে মন্ত্র কবিতার সগোত্রীয় হলেও কবিতার শৈল্পিক সিদ্ধি মন্ত্রে লভ্য নয়। এদিক থেকে কবিতার চেয়ে বরং ছড়ার সাথেই মন্ত্রের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর। তবে ছড়ার মতো মন্ত্র শুধু ধ্বনি সর্বস্ব নয়। অর্থ ব্যঞ্জনা মন্ত্রের বিশেষ গুণ। দুই, চার, ছয়, আট পঙক্তি বিশিষ্ট মন্ত্রই অধিক। দশ ও বারো পঙক্তির মন্ত্রও কম-বেশি লক্ষ্য করা যায়। কাহিনীমূলক ও উত্তর-প্রত্যুত্তর মূলক মন্ত্রও স্থান পেয়েছে আমাদের সংগ্রহে

(ক) মুখের হাসি নখের ক্ষয় ফন্নার মিছিলি ক্ষয় হয়। (মন্ত্র সংখ্যা-১৪)

(খ) চিলি মিলি আধ কপালি,

কুণ্ঠে পালু বিষের হাড়ি। (মন্ত্র সংখ্যা ১৬) (গ) সুন্দার পুকুরি মনোহর পানি

তাহাতে উপজিল শিব-শঙ্কর ওঝা দুইখিানি। (মন্ত্র সংখ্যা ২১) (ঘ) মন্ত্র মন্ত্ৰ মহামন্ত্র করিনু জপন, আল্লাহ নবীর নাম করিনু স্মরণ। (মন্ত্র সংখ্যা ১০৪)

(ঙ) যখন জন্ম নিল দেবকীর উদরে, হাসিতে খেলিতে গেল কালীদহের কূলে। (মন্ত্র সংখ্যা ৩১৫)

(চ) কৃষ্ণকে স্মর শিব করিয়া ছেদন করিলে অবশেষে নারায়ণে কোন্ (মন্ত্র সংখ্যা ১৪৫) (ছ) ঢাকে বাদ্যরে,

ঘারার ডাকে বিষম লাগে উঠলো গগনে ঢাকে বাদ্যরে৷ (মন্ত্র সংখ্যা ৩১৯)

(জ) খাটো খুটো বানারে ডরাইতে দিয়া পা

সবার মধ্যে আছেন গুণি তোমাকে গুরু বলে মা। (মদ্র সংখ্যা- ৪১২) উপরোক্ত মন্ত্রগুলো যথাক্রমে ২, ৪, ৬, ৮, ১০, ১২ পঙক্তির এবং কাহিনী

উত্তর-প্রত্যুত্তর মূলক।

মন্ত্রে ছন্দগুণের অভাব নেই। তবে স্বরবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত ছন্দই অধিক মাত্রাবৃত্ত

ছন্দ নেই বললেই চলে।

স্বরবৃত্ত ছন্দের প্রয়োগ পরিলক্ষিত হয় নিম্নোক্ত মন্ত্রটিতে

করাত করাত/ক রাত কাটে

আসতে কাটে/যাইতে কাটে Àেবা কাটে/সেবা কাটে

4+4= ৮ মাত্রা

8+4= ৮ মাত্র

8+4= ৮ মাত্রা

৪+২=৬ মাত্রা

8+4= ৮ মাত্রা

ফানুরি ও বিষ/বেদন। অপদ/'িব প'দ ৪+৪+২=১০ মাত্রা

আইজ হইতে/যাইবে বৈ কুণ্ঠে। ৪+৪+১=৯ মাত্রা

উল্লেখ্য যে, মন্ত্রে মাত্রার সমতা রক্ষা করা আদৌ সম্ভব হয়নি। কারণ, মন্ত্র আবৃত্তির জন্য রচিত নয়। একেক ওঝা একেকভাবে তার উচ্চারণ ঘটায়। কখনো তা গানের সুরে, কখনো বা অতি দ্রুত লয়ে পঠিত হয়ে থাকে। একারণে মন্ত্রের ছন্দ বিশ্লেষণ করা অত্যন্ত জটিল প্রক্রিয়া। তবে মন্ত্র যেহেতু লোককবিদের হাতের সৃষ্ট সঙ্গত কারণেই মন্ত্রের ছন্দকে অন্য কোনো বিশেষ পরিচয়ে বিশেষায়িত না করে লৌকিক ছন্দ বলায় শ্রেয় মনে হয়।

মন্ত্রের মধ্যে গীতি কবিতার স্বভাব নিহিত। তবে উৎসের দিক থেকে গীতি কবিতার সঙ্গে মন্ত্রের পার্থক্য দুস্তর। কবিতার উৎস ঘটে কবির মানস জগতের আনন্দ বেদনার রাগে রঞ্জিত হয়ে। তাতে প্রভাব পড়ে দেশ-কাল-সমাজ-পারিপার্শ্বিকতার। কিন্তু মন্ত্রের উৎস ঘটে ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। লোকহিতৈষণাই মন্ত্র রচয়িতার প্রধাণ উদ্দেশ্য। এতে রচয়িতার আত্মিক প্রেরণা ততটা কার্যকর নয় যতটা উদ্দেশ্য সিদ্ধির লক্ষ্য। গঠন প্রকৃতির দিক থেকে মন্ত্র মূলত তিন পর্বে বিভক্ত। যথা—

ক) সূচনা;

খ) বর্ণনা;

গ) প্রার্থনা বা দোহাই।

সনেটের অষ্টক ঘটকের মতোই এর পর্ব বিভাগ। এ প্রসঙ্গে সাপের বিষ নামানো বিষয়ক একটি মন্ত্র উল্লেখ করলেই পর্ব বিভাজনের আদর্শ স্পষ্টতরভাবে প্রতীয়মান হবে

মোরা বসতি করি বৈদ্য করি সার,

ফান্নার বৈদ্য করি হুকুম আল্লার ।

তিবলি পাহাড়ের মাঝে তিলকের ফোটা, যেখানে ছিল সঙ্খের সাড়ে সাত ব্যাটা। আদ্য ব্যাটার নাম আমি কহিতে না পারি,নাম বিষ নাম ঞ্জিয়ান আল্লা হরি।

এ মন্ত্রের প্রথম দুই পঙক্তিতে সূচনা; দ্বিতীয় দুই পঙক্তিতে বর্ণনা; তৃতীয় দুই পঙক্তিতে প্রার্থনা বা দোহাইয়ের পরিচয় স্থান পেয়েছে।

অধিকাংশ মন্ত্রের রচয়িতা অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত লোকচিকিৎসক তথা লোককবি। ভাষার পরিচ্ছন্নতা, ধ্বনির মূর্ছনা, ছন্দের অনুরণনের প্রতি তাদের দৃষ্টি থাকার কথা নয়। এ ছাড়া গুরুপরম্পরায় প্রাপ্ত ওঝার পক্ষে মন্ত্রে সৃজনধর্মী নতুন কিছু সংযোজন করার অবকাশ অতি সীমিত। গুরু যে ভাষায়, যে সুরে শিষ্যকে দীক্ষা প্রদান করে শিষ্য আজীবন তা হুবহু অনুসরণের প্রয়াস চালায়। তারা সজ্ঞানে ও সচেতনভাবে মন্ত্রের একটি শব্দ এমনকি বর্ণেরও পরিবর্তন ঘটাতে সাহস পায়না। তাদের প্রচলিত বিশ্বাস মন্ত্রের যে কোনো পরিবর্তন মন্ত্রগুণের কার্যকারিতায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে। কখনো কখনো স্মৃতি বিভ্রাটের কারণে ওঝাকে মন্ত্র পাঠের সময় নতুন নতুন

শব্দ এমনকি পঙক্তি সংযোজন করতে হয়। এ ছাড়া সমুচ্চারিত শব্দের ক্ষেত্রে প্রায়শঃই নতুন নতুন শব্দ বিন্যাসের পরিচয় লক্ষ্য করা যায়। এ গ্রন্থের শিশুর ক্রন্দন বন্ধের মন্ত্রগুলোতে এ পরিচয় অতি স্পষ্ট। যেমন—

(ক) চান্দনিক দেখে কান্দিনি হাসে (মন্ত্র সংখ্যা ২৬০ ) (খ) কান্দেনা কান্দিনী দুই বহিনী (মন্ত্র সংখ্যা- ২৬১) (গ) কান্দিনী মন্দিনী দুই বহিনী (মন্ত্র সংখ্যা ২৬২)

উল্লেখ্য যে, এ ধরনের পরিবর্তন শুধু নামের ক্ষেত্রেই বিশেষভাবে পরিলক্ষিত

মন্ত্র অশিক্ষিত ও স্বল্পশিক্ষিত লোকচিকিৎসকদের সৃষ্ট বলে এতে সর্বদাই আঞ্চলিক ভাষা, আঞ্চলিক পীর, লৌকিক দেব-দেবীর পরিচয় বিধৃত হয় নানাভাবে। আমাদের সংগৃহীত দিনাজপুর অঞ্চলের মন্ত্রে এ ধরনের অসংখ্য দৃষ্টান্ত লক্ষ্য করা যায়। যেমন— থিকা (থেকে), থামে (থেকে), তীরপানি (ত্রিবেনী), হাঙ্কার (হুঙ্কার), বন (বন্দ), গড়ল (গড়র), কুণ্ঠে (কোথায়) প্রভৃতি প্রকার আঞ্চলিক শব্দের সঙ্গে 'বুড়ি' (মনসা) লৌকিক দেবীর মতো আরও অনেক লোকায়ত দেব-দেবীর পরিচয় দৃষ্ট হয়।

এছাড়া বিদ্যা-বুদ্ধি ও শিক্ষা-দীক্ষার পার্থক্যের কারণে একই মন্ত্র কারো কণ্ঠে উচ্চারিত হয় বিশুদ্ধ ভাষায়, কারো কণ্ঠে আঞ্চলিক ভাষায়। দিনাজপুর অঞ্চলের যেসব মন্ত্র আদিবাসী জনগোষ্ঠীর নিকট থেকে সংগৃহীত ( ৩২২-৩৪৭ সংখ্যক মন্ত্র) সেগুলোতে এর প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায় ।

মন্ত্র লোকসাহিত্যের বিশেষ দিক। এখানে ব্যক্তি পরিচয় গৌণ, সমষ্টি পরিচয়ই মুখ্য। লিখিত সাহিত্য তা যে কালেরই হোক না কেন তাতে ব্যক্তির পরিচয় সর্বদাই থাকে স্পষ্ট। বাংলা ত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের অসংখ্য পদ-পদাবলী, মঙ্গলকাব্য, চরিত সাহিত্য সর্বত্রই ব্যক্তি পরিচয় মুখরিত। কাব্য কবিতায় ভণিতা প্রকাশের সুযোগ রয়েছে, মন্ত্রে তা নেই। একারণে মন্ত্র রচয়িতার নাম ও কালের পরিচয় সর্বদাই থেকে গেছে অজ্ঞাত। অনাদিকালের সৃষ্ট মন্ত্রগুলো লোক মুখে মুখে সৃষ্ট হয়ে লোক মুখে মুখেই লোক থেকে লোকান্তরে কাল থেকে কালান্তরে সজীব ধারায় প্রবাহমান। এই বৈশিষ্ট্যের গুণেই মন্ত্র যুগোপযোগী, চির নতুন, চির সজীব।

এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, মন্ত্রের উদ্ভব প্রচার-প্রসার শুধু বাংলার লোকসমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সারা বিশ্বের লোকসমাজে মন্ত্রের প্রভাব অতি সক্রিয়। স্টিথ থম্পসন লোককাহিনীর অনুরূপ আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে মন্ত্রেরও মটিফ সূচী প্রণয়ন করেছেন। বাংলাদেশের মন্ত্র বিশ্লেষণে এ ধারার সূচনা করেছেন ড. ওয়াকিল আহমদ। মন্ত্রের মটিফ নির্ণয় বিজ্ঞান ভিত্তিক একটি সুশৃঙ্খল পদ্ধতি। বাংলাদেশের নানা প্রান্ত থেকে মন্ত্র সংগ্রহ ও সম্পাদনার কাজ সমাপ্ত হওয়ার পরেই শুধু মটিফ সূচী নির্ণয়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে পারে। এর পূর্বে এ প্রসঙ্গে আলোচনা অযৌক্তিক ও অপ্রাসঙ্গিক বলেই আমার মনে হয়।

মন্ত্রগুণী সমাজ ও লোকোত্সবমন্ত্রের সঙ্গে ওঝার, ওঝার সঙ্গে সমাজের সম্পর্ক ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। ওঝারা সমাজের গুণী ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। কখনো কখনো মন্ত্রগুণী সমাজ তাদের মন্ত্রের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। যে অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে সমগ্র এলাকায় আনন্দের সাড়া জাগে। এমনি ধরনের একটি অনুষ্ঠানের নাম 'পাতা খেলা'। এই অনুষ্ঠানকে কেন্দ্র করে এলাকার সমস্ত ওঝার (মাহান) সমাবেশ ঘটে, তারা মন্ত্রযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। অনুষ্ঠান স্থলে বসে লোকমেলা। তাতে এলাকার হাজার হাজার নারী-পুরুষ আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার সমাবেশ ঘটে; বিক্রি হয় নানা প্রকার লোকখাদ্য। চিড়া, মুড়ি, মুড়কি, মোয়া, খাজা, বাতাসা, খাগড়াই, রসগোল্লা, সন্দেশ, জিলাপীসহ আরো বিচিত্র প্রকার আঞ্চলিক খাদ্য সামগ্রী মেলায় বিক্রির জন্য উপস্থিত করা হয়।

পাতা খেলার পরিচয় : উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলে এই খেলাটি অনুষ্ঠিত হতে দেখা যায়। আয়োজক সমিতি বিশেষ দিনে পাতা খেলার জন্য মাইকের সাহায্যে এলাকাবাসীদের অবগত করে। নির্দিষ্ট দিনে একটি বিশাল মাঠে চূণ বা সাদা মাটি দিয়ে একটি বেষ্টনি তৈরী করা হয়। মাঝখানে অনুষ্ঠিত হয় মনসা পূজা।

একটি গর্তের মধ্যে একটি মাঝারি আকৃতির কলাগাছ পোতা হয়। অতঃপর এক বা একাধিক ওঝা মনসা পূজার আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে। পুজারী পূজার নৈবেদ্য উৎসর্গ করে কলা গাছটির গোড়ায়। এই পূজায় হিন্দু-মুসলমান-আদিবাসী যে কেউ অংশ গ্রহণ করতে পারে। সমগ্র অনুষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণভার থাকে আয়োজক সমিতির ওপর।

বিভিন্ন গ্রাম থেকে আগত মাহানদের দল বেষ্টনীর নানা প্রান্তে অবস্থান নেয় এবং তাদের সম্মুখে বেষ্টনীর মধ্যে আরেকটি ছোট আকৃতির বেষ্টনী তৈরী করে। এসময় মাহানদের সঙ্গীদের হাতে থাকে ঢোল, কর্তাল, বাঁশী।

পাতা হিসেবে অংশ গ্রহণ করে তুলা রাশি বিশিষ্ট কতিপয় যুবক। মাহানরা মনসা পূজা সমাপ্ত করে পাতাদের পূজোর স্থানে উপস্থিত করে তাদের ডান হাত মন্ত্রপূত করে দেয়। অতঃপর ওঝাদের নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাতারা একসঙ্গে কলাগাছটি ভেঙ্গে ফেলে এবং ডান হাতের ঘুষিতে ঘুষিতে গাছটিকে ছিন্ন-ভিন্ন করে ফেলে। এরপর সাধারণত পাতাদের ডান হাতের আর কোনো কার্যক্ষমতা থাকে না। ওদিকে মাহানদের দল বিভিন্ন প্রান্তে বসে মন্ত্র ছাড়তে থাকে। সেসময় পাতারা পাগলের মতো মাঠের বিভিন্ন প্রান্তে দৌড়াতে থাকে। যে ওঝার মন্ত্রশক্তি যত প্রবল সে ওঝার বেষ্টনীর মধ্যে পাতার দৌড়ে গিয়ে পড়ে যায়। সেসময় মাহানের সঙ্গীরা ঢোল, কর্তাল, বাশী বাজিয়ে অপূর্ব আনন্দঘন পরিবেশের সৃষ্টি করে। এমনিভাবে পাতাগুলো দৌড়াতে দৌড়াতে বিভিন্ন ওঝার বেষ্টনীতে ধরা পড়ে আবার বাইরে চলে আসে। কোন্ ওঝার কাছে কতগুলো পাতা কতবার ধরা দিয়েছে তার সংখ্যার উপর নিরূপিত হয় ওঝা বা মাহানদের শ্রেষ্ঠত্ব । এই খেলা চলে সাধারণত এক থেকে দেড় ঘন্টা যাবৎ।

খেলা শেষে পাতাদের মন্ত্রপূত হাতগুলোকে খেলা নিয়ন্ত্রণকারী পুজারীরা পুনরায় মন্ত্রবিমুক্ত করে দেয়। পাতারা পুরষ্কার হিসেবে পঞ্চাশ থেকে একশত টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকে। অপরদিকে সংখ্যার ভিত্তিতে যে ওঝার বেষ্টনীতে যত পাতা ধরা পড়ে তার হিসেবের ভিত্তিতে প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থান নির্ণীত হয়। পুরষ্কৃত করা হয় তাদের রেডিও ঘড়ির মতো নানা প্রকার মূল্যবান সামগ্রী দিয়ে।

পাতা খেলার সমগ্র প্রক্রিয়াটি অবৈজ্ঞানিক এক উৎসব বিশেষ। কিন্তু উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত অত্র অঞ্চলের স্কুল-কলেজের শিক্ষক-অধ্যাপক-অধ্যক্ষ থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ের প্রথম শ্রেণীর রাজনীতিবিদ সংসদ সদস্য পর্যন্ত সকলের মধ্যেই মন্ত্রের কার্যকারিতায় প্রচণ্ড বিশ্বাসের অভিব্যক্তি লক্ষ্য করা যায়। এবছর নভেম্বর মাসে (২০০০) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগ আয়োজিত ফিল্ড ওয়ার্কের সময় এ ধরনের একটি অনুষ্ঠানে যোগদানের সৌভাগ্য ঘটেছিল আমার। অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হয়েছিল দিনাজপুর জেলার বীরগঞ্জ থানার দুর্লভপুর গ্রামের স্কুল প্রাঙ্গনে। উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন অত্র এলাকার আওয়ামীলীগের এবং জাতীয় পার্টির প্রাক্তন দুইজন সংসদ সদস্য সাংসদ দুইজনই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর ডিগ্রীধারী জ্ঞানী এবং সজ্জন ব্যক্তি।

লোকচিকিৎসা অসহায় মানুষের আশ্রয়স্থল। দেশে বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসর প্রচলন না ঘটা পর্যন্ত এ বিদ্যার অনুশীলন অম্লান থাকবে। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে সেই সুদিনের জন্য যেদিন সমাজ দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতার অভিশাপ থেকে মুক্ত হবে, বিজ্ঞানভিত্তিক চিকিৎসার সুযোগ দেশের প্রতিটি মানুষের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হবে।

Post a Comment

أحدث أقدم

এখানে ক্লিক করে বই ডাউনলোড করুন